শমিত, শান্তিপুর, ২৮ আগস্ট#
নদীয়া জেলার প্রাচীন জনপদ খেদাইতলা (চাকদা-র সন্নিকটে) শ্রাবণী সংক্রান্তিতে প্রায় তিনশো বছর ধরে অনুষ্ঠিত হয় মনসাপুজো ও সাপের মেলা। এই উপলক্ষ্যে সারা পশ্চিমবঙ্গ সহ পশ্চিমবঙ্গের বাইরে থেকেও শতাধিক সাপুড়িয়া তাদের সাপের ঝাঁপি নিয়ে উপস্থিত থাকে। বিভিন্ন রকমের সাপ, বিষধর এবং বিষহীন, দেখতে নদীয়া জেলা তো বটেই, সারা রাজ্যের মানুষই সেখানে সমবেত হয়।
বর্তমানে সাপুড়িয়ার সংখ্যা কমছে বলে জানা গেল বসিরহাট থেকে আগত স্বপন সাপুড়িয়ার কাছ থেকে। তিনি জানালেন যে সাপের খেলা দেখিয়ে আর পেট ভরছে না। সারা বছর এই সাপকে পুষতে প্রচুর খরচা-খরচ হয়। সেই কারণে সাপুড়িয়ার সংখ্যা ক্রমশ কমছে। মেলাটার অন্যতম বৈশিষ্ট্য মহিলা সাপুড়িয়া। দেখা যায় যে, শতাধিক মহিলা সাপুড়িয়া তাদের ছোটো ছোটো ঝাঁপি নিয়ে সাপ দেখিয়ে সমবেত মানুষদের কাছ থেকে উপার্জন করছে। \par
প্রায় পাঁচ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে মেলায় বিভিন্ন পসরা নিয়ে বিক্রেতারা হাজির থাকে। পসরার বৈচিত্র্য এখানে নজরকাড়া। হাল জোয়াল থেকে শুরু করে বেতের কাজ, মাটির কাজ, বাঁশের কাজ মানুষের নিত্য ব্যবহার্য দা-কুড়ুল-কোদাল থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকম মাছ ধরার জাল সহ বিভিন্ন রকমের যন্ত্রাংশ এখানে পাওয়া যায়। মেলার অভিনবত্ব এখানেই, এখানে হারিয়ে যাওয়া বাংলার হুঁকো নিয়ে একাধিক বিক্রেতাকে উপস্থিত থাকতে দেখা যায়। ক্রেতারা জেনে নিতে চাইল, হুঁকোর মশলাপাতি কোথায়? বিক্রেতা জানিয়ে দিলেন মশলার সুলুক সন্ধান। মশলা বাড়ন্ত হলে ক্রেতার হাতে উনি মশলা তুলে দিতে না পারার আক্ষেপ জানালেন।
মেলাটা ধর্মীয় হলেও প্রচুর সম্প্রদায়ের মানুষ, মূলত আদিবাসী এবং নিম্নবিত্ত মানুষের সমাবেশ চোখে পড়ল। চাকদা স্টেশন থেকে নেমে আধঘন্টা ট্রেকারে গিয়ে বিষ্ণুপুর থেকে খেদাইতলা যেতে আরও পাঁচ কিলোমিটার হাঁটতে হয়। এই রাস্তার অধিকাংশটাই মাটির। পাট কাটা হয়ে যাওয়ার পর মূলত মাঠের মধ্যে দিয়ে হেঁটে মেলাতলায় পৌঁছতে হয়। এবারের শ্রাবণী সংক্রান্তিতে প্রখর রৌদ্রে মানুষকে ক্লান্ত করে তুলতেও দেখা গেল। তবে সাম্প্রতিক পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে খানিকটা রাস্তা সিমেন্ট দিয়ে বাঁধিয়ে দেওয়াতে মানুষের যাতায়াতের খানিকটা সুবিধাই হয়েছে।
মেলায় মূলত পূজিত হন, মনসাদেবী এবং শিবঠাকুর। প্রচুর ছাগবলি হয়। ছাগলের রক্তে জায়গাটা কাদা হয়ে যায়, এটা দৃষ্টিকটুও বটে।
শান্তিপুর থেকে প্রায় দশজনের এক বিজ্ঞানকর্মী, ফোটোগ্রাফারের দল এই মেলাতলায় উপস্থিত হয়েছিল এবার, মূলত সাপুড়িয়াদের সঙ্গে কথা বলার উদ্দেশ্যেই। সাপুড়িয়ারা খেলায় ব্যস্ত থাকায় কথা খুব বেশি হয়নি। শান্তিপুরের বিজ্ঞানকর্মী মনোজ প্রামাণিক, অনুপম সাহা — এরা জেনে নিতে চাইল যে, সাধারণ মানুষের ভেতরে সাপ নিয়ে যে ভীতি রয়েছে, তা কাটানোর কোনো উপায় সাপুড়িয়াদের জানা আছে কি না। সাপুড়িয়ারা জানাল, ‘ভক্তি করতে হবে ওই জ্যান্ত দেবতাকে। তাহলেই সাপে আর ভয় থাকবে না।’
Leave a Reply