শমীক সরকার, ২৩ জুন, কলকাতা#
অন্তত দু–দিন আগে ২৪ ঘন্টা, এবিপি আনন্দ–সহ বড়ো বড়ো টিভি চ্যানেলে বারবার ঘোষণা শুরু হয়েছিল, বিদ্বজনেরা ২১ জুন কলকাতায় মিছিলের ডাক দিয়েছে। কামদুনি সহ রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় ধর্ষণ–খুনের বিরুদ্ধে। ইন্ধন জুগিয়ে যাচ্ছিল মুখ্যমন্ত্রীর বিভিন্ন কটু মন্তব্য, এবং তা ফলাও করে বড়ো মিডিয়ায় টানা প্রচার। আর তার সঙ্গেই ছিল বারাসতের কামদুনিতে একটি মেয়ের নৃশংস ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার পর গ্রামের মানুষের মরিয়া প্রতিরোধ — অভিযুক্ত রাজ্যের শাসক দলের আশ্রিত এক ক্ষমতাশালী গুণ্ডা ও তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা। সঙ্গে সঙ্গে মিডিয়ার আলো পড়ল একের পর এক ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায়। একটা আবহাওয়া তৈরি হয়েছিল, প্রতিদিনই ধর্ষণ ও খুন ঘটছে রাজ্যে। প্রকৃত সত্য অবশ্য এটাই। রাজ্যে প্রতিদিনই একাধিক ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। তার কিয়দংশ মাত্র লোক জানাজানি হয়। যা লোক জানাজানি হয়, তার পরিমাণও প্রতিদিন একটার কম হবে না। এবং সেগুলি লোক জানাজানি হলেও, কখনও বড়ো মিডিয়ার শিরোনাম হয় না। আমাদেরও চোখে পড়ে না ততটা, যদি না কারোর ধর্ষণের খবরগুলোতেই স্পেশ্যাল ইন্টারেস্ট থাকে।
যাই হোক, মিছিল শুরু হল পূর্বঘোষিত সময় বিকেল তিনটেতেই। কলেজ স্কোয়ার থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত প্রচুর ছোটো মিছিল হয়। সেগুলির মধ্যে কিছু কিছু দু–সারি লাইন করে রাস্তা জুড়ে চলে। আজকাল অবশ্য বেশির ভাগ সময়ই রাস্তার একদিক ধরে চলা হচ্ছে মিছিলে। আজকাল ছোটো মিছিলগুলো পুলিশ করতেও দিচ্ছে না মাঝে মাঝে। নোনাডাঙার দু‘টি বস্তি উচ্ছেদ নিয়ে একাধিক মিছিল করতে না দিয়ে মিছিলকারীদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ, লালবাজারে — তা বেশিদিনের কথা নয়। তবে আজকের মিছিলটি শুরু হতে পুলিশ বাধা দিয়েছে বলে মনে হল না। মিছিল শুরু হল রাস্তা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। মিছিলের একটি পোস্টার দেখেছিলাম ইন্টারনেটে — কলকাতা অচল হওয়ার ডাক দেওয়া হয়েছিল ভেঙে পড়া সরকার প্রশাসনের বিরুদ্ধে। নিচে লেখা ছিল, ডাক দিয়েছেন শঙ্খ ঘোষ, সৌমিত্র চ্যাটার্জি সহ জনা দশেক সেলিব্রিটি কবি, লেখক, সিনেমার লাইনের লোক। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই মিছিলে এসেছে কবি শঙ্খ ঘোষের টানে। কিন্তু তারা কি কলকাতা অচল করারও ডাক দিয়েছিলেন?
মিছিলের পুরোভাগে ছিল একটি ম্যাটাডোর, তাতে বিভিন্ন ক্ষুদে ক্ষুদে দল বা সংগঠনের কিছু কর্মী, বিভিন্ন ধরণের সরকারি বা রাষ্ট্রীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে চেনামুখ। তাদের হাতে একটি মাইক ছিল। তারা স্লোগান দিচ্ছিল, ‘ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে কেন সরকার তুমি জবাব দাও‘, ‘নারীদেহ পণ্যায়নের বিরুদ্ধে লড়তে হবে একসাথে‘ ‘জবাব তোমায় দিতেই হবে নইলে লড়াই জঙ্গী হবে‘ ‘শোকসভা নয় নীরবতা নয় ধর্ষকরাজ পুলিশিরাজ গুণ্ডারাজ নিপাত যাক‘ প্রভৃতি। ঠিক পেছনেই, মিছিলের একেবারে মাঝখানে ছিল দু–টি মিডিয়ার গাড়ি, মিছিলের দিকে তাক করা। লাইভ শো হচ্ছিল। মিডিয়া-গাড়ির পেছনে একটু ফাঁক দিয়ে সেলিব্রিটিরা এবং তাদের সাঙ্গোপাঙ্গোরা। ওই জায়গাটা থিকথিকে ভিড়। মানুষের যত না, তার চেয়ে মিডিয়ার লোকেদের ভিড় বেশি। রাস্তার আশেপাশের মানুষজনও ওইখানে কে কে আছে তা দেখার জন্য ভেঙে পড়ছিল। সবাই পকেট থেকে মোবাইল বের করে পটাপট ফটো তোলারও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। মেডিক্যাল কলেজের সামনে যেতে না যেতেই অবস্থা এমন হল, ওইখানে মিছিল দাঁড়িয়ে গেল। মিডিয়ার লোকেরা পথরোধ করে বাইট আর ফটো নিতে লাগল। এই দুর্বিপাকে সেলিব্রিটিদের সাঙ্গোপাঙ্গোরা পর্যন্ত বিরক্ত হলো। কেউ কেউ আশেপাশের লোকে যাতে হামলে না পড়তে পারে, তারজন্য হাতে হাত দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করতে লেগে গেল। ততক্ষণে মিডিয়ার গাড়িগুলিও দাঁড়িয়ে গেছে। সামনের ম্যাটাডোরটা অনেকটা এগিয়ে গেছে। সেখান থেকে জ্বালাময়ী স্লোগান উঠছে। এমন সময় মিডিয়ার কারোর কারোর স্লোগানগুলোর দিকে নজর গেল। তার খানিক্ষণ পরেই শাড়ি পরা একজন মহিলা, সম্ভবত কোনও বিদ্দ্বজন হবেন আমি চিনি না, তিনি ম্যাটাডোরের সামনে গিয়ে আঙুল উঁচিয়ে স্লোগান বন্ধ করতে বললেন। তার সাথে বেশ কিছু ক্যামেরা হাতে লোক। ম্যাটাডোরের লোকজন স্লোগান থামাতে চাইল না। তর্কাতর্কি শুরু হল। একসময় কে একজন ম্যাটাডোরের মাইকেই বলতে শুরু করল, এখানে তর্কাতর্কি করবেন না। মিডিয়া দেখছে। যাইহোক, খানিক বাদে বোঝা গেল ওই শাড়ি পরা মহিলা বিজয়ী হয়েছেন। ম্যাটাডোরের মাইকেই ঘোষণা হলো, আমাদের বলা হয়েছে স্লোগান দেওয়া যাবে না, আমরা বিচ্ছৃঙ্খলতা চাইছি না, তাই আমরা স্লোগান বন্ধ রাখছি। কিন্তু স্লোগান দেওয়া গণতান্ত্রিক অধিকার ……। যাই হোক, মিছিলের বদলে লম্বা লম্বা বক্তব্য শুরু হল মাইক থেকে। ততক্ষণে মিছিল অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে ওই ম্যাটাডোর থেকে। মাঝখানে বিস্তর ব্যবধান আর মিডিয়ার ক্যামেরা আর মিডিয়ার গাড়ি। আমি আমার ক্যামেরা আর টেপ নিয়ে মিছিলের আরও পেছনের দিকে রওনা দিলাম।
সেলিব্রিটি বিদ্বজনদের পেছনেই আর একটা জায়গায় একটা ব্যানার নিয়ে বেশ খানিকটা ভিড় এগিয়ে আসছিল। সামনের সারির মানুষদের পোশাক আশাক দেখে বুঝলাম, কলকাতার লোক নয়। পড়ে শুনলাম, এরা কামদুনি থেকে এসেছে। পরে মিছিল শেষে ধর্মতলায় গিয়ে এদের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। কেউ অবশ্য নাম বলতে চাননি। এবং সবাই বললেন কামদুনির ঘোষপাড়া থেকে এসেছেন। সবাই পুরুষ। আমি জিজ্ঞেস করলাম, মহিলারা আসেনি? ওরা বলল, গাড়ির চাকা মাঝপথে ফেঁসে যাওয়ায় আসতে পারেনি মহিলারা। যাই হোক, এই কামদুনি থেকে আসা মানুষদের সামনেও বেশ মিডিয়ার ভিড়। আর বিদ্দজন ও কামদুনির জটলাদুটির মাঝখানে একটু ফাঁকা জায়গা ছিল, সেখানে দেখলাম গগলস চোখে ডিজাইনার পোশাকে বাদশা মিত্র হিরোর মতো হাঁটছে, তাকে ঘিরে অন্তত দশটি মিডিয়া, ক্যামেরা নিয়ে তার ইন্টারভিউ নিচ্ছে। কামদুনির পেছনে আসছে বেশ কিছু সাধারণ পোশাকের পুরুষ ও মহিলাদের একটু জটলা। সেখানে একজন বড়োসড়ো চেহারার মহিলা একটা কাগজ দেখে দেখে স্লোগান দিচ্ছে, দু–বছরে পেলাম কি? সাথে আশেপাশের মিছিলকারীরা অভ্যস্ত ভঙ্গিতে হাত মুঠো করে জোরতার গলা মেলাচ্ছে, ছি ছি ছি ছি। এবং দুনিয়ার মজদুর এক হও। এই জটলাটার পরে অবিন্যস্ত কিছু লোক নীরবে হেঁটে চলেছে। মাঝেমাঝে নিজেদের মধ্যে গল্প করছে। আমার দেখে মনে হল, এরা সংগঠিতভাবে আসেনি। নিজেরাই এসেছে ব্যক্তিগতভাবে প্রতিবাদ জানাতে। সাধারণ লোক। এই প্রথম মিছিলটাকে আমার ভালো লাগতে শুরু করল।
যাই হোক, ভালো লাগাটা বেশিক্ষণ থাকলো না। আবার একটা বড়ো ব্যানার নিয়ে বড়ো জটলা আসছিল। তার একদিকে লম্বা চশমা চোখে চিকন আজিজুল হক–কে দেখা যাচ্ছিল। বুঝলাম, এরা মার্কামারা সিপিএম–পন্থী সাংস্কৃতিক কর্মী। মিডিয়া হালকা হয়ে গিয়েছিল। এই জটলাটার কাছে তাও দু–একজন ছিল ক্যামেরা নিয়ে। এটা পেরিয়ে যাওয়ার পর আর কাউকে চোখে পড়ল না। ছোটো ছোটো গ্রুপের জটলা করে আসা। ‘পথে এবার নামো সাথি পথে হবে পথ চেনা‘ গান গাইতে গাইতে এল একটি দল। পুরুষ কন্ঠে গাওয়া হচ্ছিল গানটা। এরা পেরিয়ে যেতে না যেতেই আরেকটি দল এল ‘ওরা জীবনের গান গাইতে দেয় না, নিগ্রো সংগ্রামী পল রোবসন‘ গাইতে গাইতে। এটিও পুরুষ কন্ঠ। প্রতিবাদী সঙ্গীত বা গণসঙ্গীতে সবাই যে গলা মেলাচ্ছিল তা নয়, তবে স্লোগানের বদলে অনেকেই বেছে নিয়েছিল এই গান। এদের পেছনে একটু দূরত্ব রেখে প্রচুর মানুষ কোনও কথা না বলে হাঁটছিলেন টান পায়ে। তারা গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে এসেছিলেন এমন নয়। এদের মধ্যে অনেক তরুণ তরুণী যেমন ছিলেন, তেমনি আবার বয়স্করাও ছিলেন। অনেককেই দেখে মনে হচ্ছিল না কোনও দল করেন বা কোনওরকম অ্যাকটিভিজমের সাথে যুক্ত আছেন। মিছিলের এই জায়গাটাতেই আবার আমাদের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সিপিএম দলের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত কিছু শিক্ষকের উপস্থিতি দেখে ভড়কে গেলাম। অবশ্য তারা এক জায়গায় জোট বেঁধে ছিলেন না। ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন। মনে পড়ল, গত বছর এপ্রিল মাসে নোনাডাঙার বস্তি উচ্ছেদের পর যখন সরকার প্রতিবাদ করতে একফোঁটা জায়গা দিচ্ছে না, সেই সময় কলকাতার স্টুডেন্টস হলে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি (এপিডিআর) আয়োজিত একটি সভাতে আমন্ত্রিত ছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিপিএম প্রভাবিত শিক্ষকরা। ফেসবুকে মুখ্যমন্ত্রী ও তার দলের কিছু নেতার কার্টুন শেয়ার করে একরাত জেল খেটে আসা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অম্বিকেশ মহাপাত্র–র সাথে সাথেই আমন্ত্রিত ছিল শিক্ষক ইউনিয়নের পরিচিত সিপিএম নেতা পার্থপ্রতীম বিশ্বাস। এর কাছাকাছিই দেখলাম সেলিব্রিটিদের একটি ম্যাটাডোর। অভিনেতা পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবিপি আনন্দকে ইন্টারভিউ দিচ্ছেন ম্যাটাডোরে চড়ে। মিছিলের একদম প্রথমে প্রতিবাদী কর্মীদের ম্যাটাডোরেও আজতক চ্যানেলের দুটি ছেলেকে উঠে ইন্টারভিউ নিতে দেখেছিলাম।
এবার মিছিলে দেখা গেল ক্ষুদে ক্ষুদে প্রতিবাদী গোষ্ঠীগুলির কর্মী, প্রতিবাদী নাট্যকর্মী, বা ছোটো ছোটো দলের সাথে যুক্ত মানুষদের জটলা করে আসা। মিছিলের ঘোষণাতেই ব্যানার ছাড়া আসতে বলা হয়েছিল সবাইকে। তাই অনেকেই নিজেদের সংগঠনের নাম না লিখে ধর্ষণ, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে ব্যানার নিয়ে এসেছিলেন। কয়েকটি ব্যানারে মিডিয়ার শিরোনামে উঠে আসা ধর্ষণের ঘটনাগুলিকে অগ্রাধিকার দিয়ে লেখা ছিল, যেমন বানতলা, সিঙ্গুরে তাপসী মালিক, নন্দীগ্রামে রাধারাণী আড়ি, কামদুনি, গেদে …। কেউ কেউ লালগড়ে পুলিশের নিপীড়নের শিকার ছিতামণি মূর্মূ–র নামও লিখেছিলেন পোস্টারে ব্যানারে। ব্যানার–পোস্টার ছাড়া গান গাইতে গাইতে চলল অর্ধেক আকাশ নামে একটি সংগঠনের কর্মীরা — সব কমবয়সী। এল ইউএসডিএফ, আইসা, ক্রান্তিকারী নওজওয়ান সভা, পিডিএসএফ, যুব ভারতের কর্মীরা — সবাই ছাত্র যুব। সংগঠনের ব্যানার ছাড়া। ছিল এপিডিআর। এদের সবাইকেই আমি কমবেশি চিনি। প্রতিবাদের চিরকেলে চেনামুখ। একটি নাটকের দল নাটক করতে করতে এগিয়ে চলল। ভেসে আসছিল তাদের নাটকের কলি, ‘এইভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রতিরোধ একদিন …’। ‘সংগ্রামী শ্রমিক মঞ্চ‘ নামে একটি সংগঠন অবশ্য নিজেদের বড়ো ব্যানার নিয়ে এসেছিল। বোঝাই যাচ্ছিল, তারা ব্যানার না আনার নির্দেশ ইচ্ছে করে অমান্য করছে। ছিল অহল্যা প্রভৃতি কয়েকটি নারী সংগঠনের কর্মীরাও। বেশ কয়েকটি এনজিও–কেও দেখা গেল গোষ্ঠীবদ্ধভাবে ব্যানার নিয়ে এগিয়ে চলতে, নাম না দিয়ে। ‘রূপান্তরকামী নারী‘ নামে ‘মূলধারা‘র বাইরের যৌনতার একদল মানুষ ধীরে ধীরে ব্যানার নিয়ে এগিয়ে চলল। এই সংগঠিতভাবে চলার মধ্যে মধ্যেই আবার অসংগঠিত মানুষকেও পথ চলতে দেখা গেল। একদম শেষের দিকে দেখলাম কামদুনির কাছেই বাদু–র একটি এনজিও সংগঠন ক্ষেতমজুর সমিতি দৃপ্ত স্লোগান দিতে দিতে চলেছে। আর মিছিলের একদম শেষে সাদা এবং খয়েরি পোশাকের প্রচুর পুলিশের মিছিল।
আমার দেখা মিছিলের বর্ণনা মোটামুটি এইরকম। মিছিলের আশেপাশে প্রচুর মানুষ দাঁড়িয়ে গেছিল। কলেজ স্ট্রীটের আশেপাশের মানুষ সাধারণত ছোটো ছোটো মিছিল দেখে অভ্যস্ত। মূলত কলকাতার প্রতিবাদী মানুষেরা কলেজ স্ট্রীট থেকে ধর্মতলা অবদি মিছিল করেন দীর্ঘদিন ধরেই। সেই মিছিলগুলো বেশি বড়ো হয় না। আজকের এই বড়ো মিছিল দেখে পথচলতি অনেকেই বলছিলেন, মিছিলটা বেশ বড়ো। কেউ কেউ সেলিব্রিটি দেখতে হামলে পড়ছিলেন। আবার অনেকে হাঁ করে দেখছিলেন মিছিলটা। মুখের অভিব্যক্তি দেখে ভালো–মন্দ বোঝা মুশকিল। একজন পায়ে প্লাস্টার করা ধুতি পাঞ্জাবি পরা লোক বললেন, এইসব করে কিচ্ছু হবে না, রামদেব বাবা বলেছেন, দশ–বারোটা মন্ত্রীকে ধরে ঝুলিয়ে দাও, এমনিই কাজ হবে। রাস্তার ধারে একজন আরেকজনকে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কি নিয়ে মিছিল। তিনি একটু কেমনভাবে উত্তর দিলেন, ধর্ষণ ধর্ষণ। আমার মনে হল, ধর্ষণ নিয়ে মিছিল, এটা রাস্তার আশেপাশের শ্রমজীবি সাধারণ মানুষ ঠিক মেনে নিতে পারছে না। ধর্ষণ আমাদের সমাজে আজও লুকিয়ে রাখার মতো জিনিস। প্রকাশ্যে ওই নিয়ে আলোচনা চলে না। ওই বিষয় নিয়ে প্রকাশ্য মিছিল নিয়ে অনেকেই অস্বস্তিতে। আবার মিডিয়ার কল্যাণে ধর্ষণের কথা তো ঘরে ঘরে পোঁছচ্ছে। কেমন তাড়া করছে যেন। সেলিব্রিটিরা সরব, সেটা মিডিয়াতে দেখাও যাচ্ছে। তাই মিছিলের সাথে কোনওভাবেই না মিশে গিয়েও পাশ থেকে মিছিল দেখলেন বহু মানুষ। মিছিলে হাঁটা সাত–আট হাজার লোকের তুলনায় সেই সংখ্যাটাও খুব কম হবে না। অবস্থা দেখে মিছিলের শেষ দিকের একটি সাংস্কৃতিক গোষ্টীর কিছু যুবক কর্মী স্লোগান দিতে শুরু করল, আশেপাশের মিছিল দেখতে থাকা লোকেদের মিছিলে যোগদান করার আহ্বান জানিয়ে।
মিছিলটা বড়ো হয়েছে, এই আনন্দ ফুটে বেরোচ্ছিল মিছিলে উপস্থিত কিছু সাংস্কৃতিক লোকেদের চোখেমুখেও। একজন তো মিছিলের মাঝপথেই সেলিব্রিটিদের ম্যাটাডোরের পাশেই দু-হাত তুলে হেসে আনন্দ প্রকাশ করলেন, আমার ক্যামেরায় ধরাও আছে সেই উচ্ছ্বাস। ধর্ষণ–হত্যার ঘটনার বিষাদ বা সরকারের প্রতিক্রিয়ার প্রতি ক্রোধের বদলে এই আনন্দ বেশ দৃষ্টিকটু লাগছিল। মিছিলে মহিলাদের উপস্থিতির তুলনায় পুরুষের উপস্থিতি ছিল অনেক বেশি। তিনভাগ আর একভাগ বলে আমার মনে হয়েছে। মিছিলে পুরনো শাসক, অধুনা বিরোধী দল সিপিএমের অনেক কর্মী উপস্থিত ছিল। তাদের সংগঠিত বা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা উপস্থিতি মিছিলের অর্ধেকটা জুড়ে ছিল। বাকি অর্ধেকটার বারো আনা ছিল বিভিন্ন ধরণের প্রতিবাদী সমাজকর্মীরা — এনজিও থেকে শুরু করে বিভিন্ন ছোটো রাজনৈতিক সংগঠন, নাট্যগোষ্ঠী প্রভৃতি। আর চার আনা ছিল তথাকথিত সাধারণ মানুষ। এইরকমই আমার মনে হল। টানা দু–দিনের মিডিয়ার প্রচারের কল্যাণে তারা এসেছিল কি না কে জানে, তবে কামদুনির গ্রামের মানুষের দাঁত কামড়ে প্রতিরোধ, বড়ো মিডিয়ার লাগাতার প্রচার আর সরকারি নিষ্ঠুরতা মিলেমিশে বাকিদের যে একজোট করেছিল — তাতে সন্দেহ নেই।
ফিরে এসে শুনলাম, মিডিয়ায় প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব রুদ্রপ্রসাদ বলেছেন, জেগে আছি এটা প্রমাণ করার জন্য মিছিলে গিয়েছিলাম। মনে পড়ল মিছিলের আর একটি মুখের কথা। বিদ্যাসাগর কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, এয়ারপোর্টের বাসিন্দা জিমি হেমব্রম তার এক বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে অন্য হাতে একটা ছোট্ট হাতে লেখা পোস্টার মাথার ওপরে ধরে নিয়ে এগোচ্ছিল। প্রথম দিকে সেটায় কেবল একটাই শব্দ লেখা ছিল ডট পেনে, পিস (শান্তি)। আর একটু পরে দেখলাম, সে আবার নিজে হাতে কলম দিয়ে ওই পিস শব্দটার নিচে লিখেছে, জাস্টিস (ন্যায়বিচার)। নামধাম শুধোনোর পর জিজ্ঞেস করলাম, তুমি এক্ষুনি হাতে লিখলে জাস্টিস। কেন? সে বলল, এই ভয়াবহ ঘটনার পর সরকার চাকরি দিয়ে টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করে দিতে চাইছে। কিন্তু আমরা তো চাই জাস্টিস। তাই লিখলাম। জানিনা ছেলেটি কোনও বড়ো দলের ছাত্র সংগঠনের কর্মী কি না। কিন্তু তার ছোট্ট ব্যক্তিগত উপস্থিতি, চোখ জুড়োনো বড়ো পোস্টার ব্যানারে কিছু লিখে নিয়ে যাওয়ার বদলে, মিছিলে আসার পর একটা খাতার পাতা সাইজের লিফলেটের সাদা উল্টোপিঠে ডটপেন দিয়ে পিস আর জাস্টিস শব্দদুটো লিখে নিয়ে নিজের মাথার ওপর তুলে ধরে হাঁটার তুচ্ছ উপস্থিতি মিছিলটাকে একটা অন্য মাত্রা নিয়ে হাজির করেছিল আমার কাছে। কোনও কিছু প্রমাণ করতে নয়, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা বা রক্ষার মতো কোনও মহতী উদ্দেশ্য নিয়ে নয়, লোক দেখাতেও নয় — তার এবং তার মতো আরও কিছু মানুষের এই সামান্য অথচ সরাসরি উপস্থিতি মনে করিয়ে দিচ্ছিল গত ডিসেম্বর মাসে দিল্লির শাসকের মহল্লায় সকালে তিন–তিনবার পুলিশের জলকামান খেয়েও ন্যায়বিচারের দাবি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তরুণ তরুণীদের কথা।
Leave a Reply