সুজয় বিশ্বাস, কোচবিহার, ২৬ ডিসেম্বর#
বড়োদিনের সকাল। আসামে গণহত্যার খবরকে পাশ কাটিয়ে এক ফটোগ্রাফার বন্ধুর সঙ্গী হয়ে পৌঁছলাম এক আদিবাসী গ্রামে। পাঁচটা সাদা গাড়ির কনভয় নিয়ে একজন জনপ্রতিনিধি এসেছেন। তাঁর অনুগামীরা গাড়ি থেকে কম্বল নামাচ্ছেন গরিব খ্রিস্টানদের মধ্যে বিতরণের জন্য। দেহরক্ষীরা অত্যাধুনিক বন্দুক নিয়ে সতর্ক প্রহরায়। আমরা তাদের পিছু পিছু পৌঁছালাম ক্যাথলিক চার্চে।
অনাড়ম্বর আয়োজন, তথাপি ভাবগম্ভীর পরিবেশ, আনন্দের আবহ। গীর্জার সামনের মাঠে দশ বারোটি চেয়ার পাতা; মাঝেরটিতে বসলেন জনপ্রতিনিধি; সৌম্যকান্তি, বিচক্ষণ। তাঁর দু-পাশে বসলেন স্থানীয় অনুগামীরা। কেউ স্তাবক, কেউ উমেদার, কেউ প্রবঞ্চক, কেউ বা এসেছে কোনো ছোট্ট স্বার্থসিদ্ধির আশায়। গীর্জার পক্ষ থেকে জনপ্রতিনিধিদের জন্য প্রার্থনা করা হল, ‘হে প্রভু, মাননীয় জনপ্রতিনিধি … প্রতি বছর এই দিনটিতে আমাদের আতিথ্য গ্রহণ করে আমাদের ধন্য করেন। তাঁর সহযোগিতা থেকে আমরা কখনোই বঞ্চিত হই না। হে প্রভু, তুমি তাঁর জীবনকে সুরক্ষিত রেখো। তুমি তাঁকে ও তাঁর পরিবার পরিজনকে নিরাপদে রেখো। হে প্রভু, তিনি যাতে সুস্থ শরীরে, আনন্দিত চিত্তে সারা জীবন মানুষের সেবা করতে পারেন সেদিকে তুমি লক্ষ্য রেখো। হে প্রভু, তিনি যেভাবে সুস্থ শরীরে বাড়ি থেকে আমাদের এখানে এসে পৌঁছেছেন ঠিক সেভাবেই যেন নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারেন। হে প্রভু, একইভাবে তুমি তাঁর অনুগামীদের ও দেহরক্ষীদেরও সুরক্ষিত রেখো। হে প্রভু, তুমি তাঁকে আশির্বাদ কোরো …’।
এরপর জনপ্রতিনিধি সপারিষদ গীর্জার ভেতরে ঢুকলেন; আসন গ্রহণ করলেন। চিত্র-সাংবাদিকদের ক্যামেরা ফ্ল্যাশ করল কয়েকবার। শুরু হল প্রার্থনা, আদিবাসী ভাষায়। এরপর জনপ্রতিনিধি কেক কাটলেন। সংক্ষিপ্ত ভাষণে তিনি বিশ্ববাসীর মঙ্গল কামনা করে শান্তির ললিত বাণী উচ্চারণ করলেন (যদিও সাম্প্রতিক কালের গোষ্ঠী সংঘর্ষে তাঁর নিজেরই দলের বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছেন বলে সংবাদে প্রকাশ)। গীর্জার প্রতিনিধিরা আমাদের পিঠে খাওয়ালেন। তাদের আন্তরিকতায় মুগ্ধ হলাম। জনপ্রতিনিধি যে কেকটি কেটেছিলেন, তার ‘প্রসাদ’ অবশ্য সবাই পেল না।
এরপর নাম ডেকে ডেকে কম্বল বিতরণ করা হল। টিভি চ্যানেলে সাংবাদিকরা বাইট নিল; জনপ্রতিনিধি একই ভঙ্গিতে, একই ভাষায় বিশ্ববাসীর মঙ্গলকামনা করে শান্তির বাণী শোনালেন। ক্যাথলিক চার্চের প্রভাতী অনুষ্ঠান শেষ হল।
এরপর প্রোটেস্টান্ট চার্চ। অপেক্ষাকৃত বর্ণময় আয়োজন। জনপ্রতিনিধিকে বরণ করার পর গীর্জার একজন বয়স্ক প্রতিনিধি ধর্মগ্রন্থ থেকে বাণী পাঠ করলেন, ‘প্রশাসকগণ ঈশ্বর দ্বারা নিযুক্ত। সেই কারণে প্রশাসকগণের বিরুদ্ধতা করার অর্থ ঈশ্বরের অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধতা করা। প্রশাসকগণ সুনাগরিকের প্রতিপালন করেন এবং অপরাধীদের শাস্তি দেন। একমাত্র অপরাধীরাই প্রশাসকগণের বিরুদ্ধতা করিয়া ঈশ্বর কর্তৃক অভিশপ্ত হয়।’ — কোন ধর্মগ্রন্থ কে জানে! তবে বেশ জ্ঞান অর্জন করা গেল!!
এখানে দেখি কেকের ছড়াছড়ি। স্থানীয় বেকারির তৈরি সাধারণ কেক, বিখ্যাত কোম্পানির সুস্বাদু কেক এবং মঞ্চের ওপরে বেশ বড়ো মাপের একটি ক্রিম কেক। আহা! — জনপ্রতিনিধি ধীর স্থির শান্ত ভঙ্গিতে কেক কাটলেন, তারপর একই স্বরক্ষেপণে আবারও বিশ্ববাসীর মঙ্গল কামনা করে শান্তির বাণী শোনালেন। শুরু হল কেক বিতরণ।
সুন্দরী সুবেশা একজন মহিলা প্রথম ও দ্বিতীয় সারির অতিথিদের মধ্যে ক্রীম কেক বিতরণ করতে লাগলেন; একজন ভদ্রলোক বিখ্যাত কোম্পানির কেক দিতে লাগলেন — মাঝের সারির অতিথিদের এবং একজন যুবক বিশাল এক গামলায় স্থানীয় বেকারির কেক নিয়ে এগিয়ে এলেন পেছনের দিকে। এখানে অতিথিদের সংখ্যা অনেক বেশি, যাদের মধ্যে আমিও একজন। আর আছে অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়ে। বছর দশেকের একটি ছেলে সাধারণ কেক খেতে খেতে সব কিছু লক্ষ্য করছিল। সুন্দরী সুবেশা মহিলা বিশেষ কোনো অতিথিকে কেক দেবার জন্য ক্রিম কেকের থালা হাতে পেছনের সারির দিকে এগিয়ে আসতেই এই ছেলেটি হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, ‘ইয়ে গলত হ্যায়, ইয়ে গলত হ্যায়, বড়োলোকদের জন্য ভালো কেক আর আমাদের এমনি কেক। ইয়ে গলত হ্যায়।’ — ঘুরে তাকালেন মহিলা। চোখে মুখে বিরক্তি; অসহিষ্ণুতা। থমকে দাঁড়িয়ে থাকলেন কয়েকটি মুহূর্ত। তারপর কী মনে করে ক্রিম কেকের ছোট্ট একটি টুকরো তুলে দিলেন ছেলেটির হাতে।
অনিবার্য কারণে স্থান কাল পাত্র উল্লেখ করা হল না।
Leave a Reply