১০ জুন, প্রদীপ জানা, মেটিয়াবুরুজ#
রেল রোকোর কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল চার-পাঁচ মাস আগে। এর আগে একবার কর্মসূচি পিছিয়ে দিয়ে শেষপর্যন্ত গতকাল হল। গতকালের তারিখটাও ঠিক হয়েছে মাসখানেক আগে। রেল রোকোর পিছনে মোদ্দা কথা ছিল এই, এর আগে বামফ্রন্টের আমলে বন্ধ কারখানার শ্রমিকদের যে বেকারভাতা স্থির হয়েছিল তার পরিমাণ বাড়িয়ে ৩০০০ টাকা করা, ইএসআই কার্ডটাকে রানিং রাখা, বিপিএল কার্ড করা, বেকারভাতা দেওয়ার ক্ষেত্রে ৫৮ বছরের উর্ধসীমাকে বাতিল করা, সমস্ত বন্ধ কারখানা খুলতে হবে। এইরকম কয়েকটা বিষয় নিয়ে শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটককে চিঠি দেওয়া হয়। উনি বলেছিলেন, এগুলো ন্যায্য দাবি। বোধহয় জানুয়ারি মাসে মন্ত্রীর কাছে যাওয়া হয়েছিল। এরপর ধর্মতলায় একটা মিটিংও হল এই বিষয় নিয়ে। সেই থেকে কিছু না হওয়ায় এই রেল রোকোর কর্মসূচি নেওয়া হল। আমাদের পোদ্দার প্রজেক্টের শ্রমিক আর সংগ্রামী শ্রমিক ইউনিয়ন এতে ছিল। মজদুর ক্রান্তি পরিষদের কর্মীরা বেহালা, হাইড রোড, আরও জায়গা থেকে এসেছিল। গতকাল আমাদের বেকারভাতার ফর্ম ফিল-আপের ডেট রাখা হয়েছিল। যাতে শ্রমিকেরা রেল রোকোতে থাকে, সেইজন্য গ্রাম থেকে তাদের আনা হয়েছিল। দূর থেকে আসবে, তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল মুদিয়ালিতে।
কালকে কর্মসূচি শুরু হয়েছে মোটামুটি সকাল আটটা পঞ্চান্নতে। আমার যেতে একটু দেরি হয়েছিল। আমরা ছিলাম ব্রেসব্রিজে। আরেকটা অবরোধ হয়েছিল কল্যাণীতে, এছাড়া হিন্দমোটর আর বাউড়িয়ায়। পুলিশ আর জিআরপি আগেই এসে গিয়েছিল। পোস্টারিং তো অনেকদিন থেকেই করা হয়েছিল, সেইমতো ফোর্স দিয়ে দিয়েছিল। অবরোধ শুরু হওয়ার আগেই ট্রেন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যা ঢোকার আগেই ঢুকে গেছে। আমরা ব্রেসব্রিজে ট্রেনের মুখোমুখি হইনি। আড়াই-তিনশো লোক ছিল। তার মধ্যে পোদ্দারের ত্রিশ-চল্লিশজন ছিল। এক ঘণ্টা প্রোগ্রাম হল। যে সময়সীমাটা বাঁধা ছিল, ঠিক এক ঘণ্টা হতেই পুলিশ এসে রেললাইনে নামল। তার মধ্যেও তিন-চার মিনিট বক্তৃতা হল। অবরোধ তুলে নেওয়া হল, কোনো ধাক্কাধাক্কি হয়নি।
এর আগে লেবার দপ্তর থেকে বলা হয়েছিল, তারা আমাদের দাবিগুলো বিবেচনা করছে, এই কর্মসূচিটা যাতে না নেওয়া হয়। দেখা যাক, এখন কী হয়। অবরোধ উঠে যাওয়ার পরে পোদ্দারের শ্রমিকেরা সাইকেলে করে বাসে করে যে যার মতো চলে গেল মুদিয়ালিতে। ওখানে ফর্ম ফিল-আপ আর খাওয়াদাওয়া হয়েছে। আমি আর যাইনি। আমি পরে ফর্ম ফিল-আপ করব।
আলমপুরে পোদ্দারের কোয়ার্টারে যে জায়গাগুলো আছে, সেখানে প্লট প্লট ভাগ হচ্ছে, পাঁচিল হচ্ছে। আসলে কী যে হচ্ছে কিছু জানা নেই। ইউনিয়নের এখন যা অস্তিত্ব, থাকতে হয় থাকা। আমরা যে সবসময় বলি, শ্রমিক নেতৃত্ব দেবে, একদম বাজে কথা। আগেও ছিল না, এখনও নেই। শুধু স্বপ্ন দেখে হা হা করা। বাইরে থেকে যে নেতা থাকে তার কথাই শেষ কথা। এই করতে করতেই ইউনিয়নগুলো শেষ হয়ে যাচ্ছে। ১৯৯৭ সালে পোদ্দার কোম্পানি বন্ধ হয়েছে। কত লোক বুড়ো হয়ে গেছে, অচল হয়ে গেছে, মরে গেছে, সুইসাইড করেছে। সত্যি কথা বলতে কী, যারা এসেছিল রেল রোকোতে, লড়াই করতে হবে এই মানসিকতা নিয়ে আসেনি। আমিও সেভাবে যাইনি। যেহেতু বেকারভাতার পয়সাটা পাই, আমি যদি না যাই, ইউনিয়নের দ্বারা ফর্ম ফিল-আপ করতে হবে, সেখানে দুটো কথা শুনতে হবে, তার চেয়ে বাবা যাই একবার। তিনবছর হল মাসে দেড়হাজার টাকা করে পাচ্ছি। বছরে দুবার ব্যাঙ্ক থেকে পেমেন্ট হয়। বছরে একবার দেড়হাজার টাকা বোনাসও দেয়।
সত্যিকারের বললে এই টাকাটার দরকার নেই আমাদের। এবারে যখন হারামে পাওয়া যাচ্ছে, ভালোই! এই টাকাটা যদি সরকার বন্ধ করে দেয়, তাহলে যে শ্রমিক রাইটার্স ঘিরবে বা লড়াই করবে, মোটেই নয়। তখন শ্রমিক চাকরি থেকে রিজাইন দেবে। রিজাইন দিলে পিএফের টাকাটা পাবে। ১৯৯৭ সালের আগের গ্রাচুইটির টাকাটা পাবে। তার মধ্যে যে বছর পিএল হয়নি, ২৪০ দিন ডিউটি নেই, সেবছরের গ্রাচুইটি কাট। যে বছর মিল বন্ধ ছিল, সেবছরের গ্রাচুইটি কাট, এইসব কেটেকুটে যে গ্রাচুইটিটা দিচ্ছে, সেই টাকায় একজন শ্রমিক বিহার থেকে এলে তার গাড়িভাড়াও হবে না। মিল বন্ধ হওয়ার আগে ছিল ১৩০০ শ্রমিক, এখন রয়েছে তিনশোর মতো। এর মধ্যে কন্ট্রাক্ট লেবারও আছে।
শ্রমিকের লড়াইটা থাকবে কী করে? আমরা যতই বলি, লড়াই করব, অন্য কারখানার শ্রমিকের পাশে দাঁড়াব, একেবারে মূল্যহীন কথা এগুলো। এর মধ্যে গালগল্প ছাড়া কোনো কিচ্ছু নেই। আমি যেভাবে দেখছি, সেইভাবে বলছি। আমার অসুস্থ বউকে নিয়ে যে এত টানাটানি গেল, কোনো ইউনিয়নের লোক কি একদিনের জন্যও একবার দেখতে এসেছে? যখন কোনো কর্মসূচি থাকছে, তখন এসে জানাচ্ছে, হ্যান্ডবিল দিচ্ছে। অথচ বিশ বছরের ওপর এদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক।
Leave a Reply