শমীক সরকার, মদনপুর, ৯ এপ্রিল#
সন্ধ্যেবেলার ভিড়ে ঠাসা কৃষ্ণনগর লোকালটায় ব্যারাকপুর থেকে উঠে কোনোমতে ভেতরে ঢুকেছেন মহিলা। মধ্যবয়স্ক মোটাসোটা, এক হাতে চেপে ধরা আলুকাবলি, অন্য হাতে একটা নাইলনের ব্যাগ। আশেপাশে যারা বসে ছিল, তাদের জিজ্ঞেস করলেন, সবাই কৃষ্ণনগর যাবেন? প্রায় সবাই শ্যামনগরের আশেপাশে নামবে, আমিও দাঁড়িয়েছিলাম লাইনে, বললাম, ণ্ণআমার সামনের জন নামলেই আপনাকে বসতে দেব’। মহিলা অমায়িক হেসে আমাকে বললেন, ণ্ণহাতে খাবার আছে তো, বসে একটু খাবো।’ শ্যামনগরে তিনি বসলেন, আমিও। আগে গোগ্রাসে আলুকাবলিটা খেলেন, নাইলনের ব্যাগ থেকে প্লাস্টিকের জলের বোতল বের করে জল খেলেন। তারপর নিজেই বললেন আমাকে, ণ্ণসারা দিনে এই প্রথম খেলাম। সেই ভোরবেলা আসি, দিনে কিছু খাই না, সন্ধ্যেবেলা এই খাওয়া।’ আমি অবাক হয়ে তাকাতেই বললেন, ণ্ণআজ তিরিশ বছর ধরেই এই চলছে। এবার রাত্রে বাড়ি গিয়ে ভাত খাবো’। আমি জিজ্ঞেস করলাম, দুপুরে মুড়িটুরি কিছু খেতে পারেন না? বললেন, ণ্ণমুড়ি, ছাতু এসব তো আমার সাথেই থাকে, সারাদিন ওই নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি, তাই আর খেতে ইচ্ছে করে না।’ আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি কাজ করেন? উনি বললেন, ণ্ণআমি বসি। ব্যারাকপুর চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের টিকিট কাউন্টারের গায়ে’। খানিক সময় লাগলো আমার বুঝতে উনি কি করেন। বুঝে জিজ্ঞেস করলাম, ণ্ণও আপনি মুড়ি ছাতু নিয়ে বসেন?’
— হ্যাঁ, মুড়ি মানে লাল মুড়ি। ছাতু এইসব। আমার লাল মুড়ির দাম একটু বেশি। আড়াইশো-র প্যাকেট বারো টাকা, তিনশোর পনেরো টাকা। … এতে ইউরিয়া বা সোডা থাকে না।
— বাড়িতে ভাজেন?
— হ্যাঁ। আমি ভাজি না, মেয়ে আর ছোটো ছেলের বৌ ভাজে। হাড়িতে। বালি দিয়ে। আজ এতক্ষণে কালকেরটা ভাজা হয়ে গিয়েছে। ছোটো ছেলে রাত্রে প্যাকেট করে।
— চাল?
— চাল আসে কাটোয়া থেকে। গাড়িতে করে দিয়ে যায়। লাল শির আছে চালটায়, দেখলেই চিনতে পারবে। এই মুড়ি নিতে অনেক দূর দূর থেকে লোক আসে, একসাথে কয়েক কেজিও কিনে নিয়ে যায়। আমি কোনোদিন খারাপ জিনিস দিই না।
— কতদিন ধরে আপনার এ ব্যবসা?
— আজ তিরিশ বছর ধরে মুড়ি ছাতু বেচছি। আগে ঘুরে ঘুরে বসতাম। কল্যানী, মদনপুর, উল্টোডাঙা, রানাঘাট। এখন বয়স হয়ে গিয়েছে, আর পারি না। ওই কাউন্টার থেকে বলেছে, ওখানেই বসতে। লাইন ধরা আছে।
— কিছু দিতে লাগে?
— না। তবে বিশ্বকর্মা পূজো দুর্গা পূজোর সময় একশ’ দুশ’ টাকা দিতে হয়। তাও জোরাজুরি করে না, বলে বুড়ি মানুষ, কোথা থেকে পাবে? … আমার পাশে বসে পিয়ারা নিয়ে একজন। এখন একেকটা পিয়ারা পনেরো টাকা করে। গরীব মানুষ খেতে পারবে না। … আমার ছোটো ছেলে আমার কাছেই থাকে। কল্যানীতে অটো চালায়। আমি কিনে দিছি। বড়োটা আলাদা থাকে, ওর ঘুগনির দোকান, ওকেও গাড়ি কিনে দিছি। ঘুগনির গাড়ি। … ছোটোটা একটু আগে ফোন করল। আমি যতক্ষণ না যাবো, অটো নিয়ে বসে থাকবে। আমি গেলে আমাকে নিয়ে বাড়ি যাবে। চাঁদামারি আমাদের বাড়ি। ওইটাই ওর লাস্ট ট্রিপ। যত রাতই হোক আমার, আমাকে না নিয়ে বাড়ি যাবে না। … বাড়ি গিয়ে আমার আর কোনো কাজ নাই। চান করব। তারপর ভাত খাবো। তারপর টিভি দেখতে বসব। সিরিয়াল। তারপর ঘুম। ছোটো ছেলে মুড়ি ছাতু সব প্যাকেট করবে। … ছোটো মেয়েটার কাছেই বিয়ে হয়েছে। আমি ওকে বলেছি, দিনের বেলা এসে বাড়িতে কাজ মুড়ি ছাতু বানাবি। ওইবেলা খাবি। রাতে ঘরে যাবি। ওকে শুক্রবার শুক্রবার দু-শো টাকা করে দিই হাত খরচের জন্য। অন্য দুই মেয়েকেও মাঝে মাঝে দশ বিশ হাজার দিই। সবাইকেই দিই কিছু না কিছু। এই মুড়ি নিয়ে বসেই আমার যা কিছু। … ওখানে আমি না বসে আমার ছেলে যদি বসতে চায়, দেবে না। আমি বুড়ি মানুষ বলে কিছু বলে না। আগে রবিবার বসতাম না, এখন রবিবারও বসি। সেই ভোরবেলা চলে আসি। চল্লিশ কেজি মাল নিয়ে। ট্রেনে ওঠায় কুলি, নামিয়ে নিয়ে বসার জায়গায় নিয়ে যায় কুলি।
— রোজ সব কিছু বিক্রি হয়ে যায়?
— হ্যাঁ। আমার মাল থাকে না। সন্ধ্যেবেলা অফিস ছুটির সময় সব শেষ হয়ে যায়। যদি কোনোদিন একটুখানি থেকে যায় তো কাউন্টার থেকেই বলে দেয় এক কোণে রেখে দিতে।
— মাসির কোনো জমি নেই?
— নাঃ আমাদের কোনো জমি নেই। আমাদের ব্যবসা। আগে জমি ছিল। আমি নিজে চাষ করতাম। কিন্তু সব বিক্রি করে দিয়েছি। আমার ছেলেরা চাষ পারে না। খাটতে পারে না।
— আপনার নাম কি?
— আমার নাম পুষ্প মণ্ডল। আমার ছেলের নাম কালু, অটোর লাইনে ডাকে গোবিন্দ বলে। ওর গায়ের রঙ ফর্সা ছিল তাই নাম দিয়েছিলাম কালু। অটো চালাতে শুরু করলে তো একটা ভালো নাম দিতে হবে, তো তখন নাম হলো গোবিন্দ।
— গরম পড়েছে খুব।
— হ্যাঁ, এবার খুব গরম পড়বে। বৃষ্টি নেই, আমের বোল আসছে না। … গতবার খুব আম হয়েছিল। দশ টাকা কেজি পনেরো টাকা কেজিতে ভালো ভালো আম বিক্রি হয়েছে।
— মাসি ভোট দেবে না?
— ভোট কবে, চৈত্র পেরিয়ে হলে ভালো হয়। ওইদিন তো ছুটি নিতে হবে। — একগাল হেসে বললেন পুষ্প। অনেকবার করে আমাকে দোকানে গিয়ে লাল মুড়ি একবার কিনবার কথা বলে কল্যানী নেমে গেলেন তিনি। আমার গন্তব্য তার পরের স্টেশন, মদনপুর।
Leave a Reply