কুশল বসু, কলকাতা, ১১ জুলাই#
বিপ্লব ফিরে এল মিশরের রাস্তায়।
মুবারক জমানা পরবর্তী মিশরের নয়া প্রেসিডেন্ট, ইসলামপন্থী মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক সংগঠনের মোহাম্মদ মোরসি প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে বিরোধী পক্ষগুলির বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল ২২ নভেম্বর ২০১২ থেকেই। মুবারক জমানায় মানুষের ওপর উৎপীড়নকারী পুলিশ অফিসারদের মধ্যে অনেকেই খালাস পেয়ে গিয়েছিল, তাদের পুনর্বিচার এবং শাস্তি নিয়ে উচ্চবাচ্য করেননি মোরসি। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যেও ক্ষোভ বাড়তে থাকে। নয়া সংবিধান ও প্রেসিডেন্টের বাড়তি ক্ষমতাও মানুষকে বিরক্ত করেছিল।
জানুয়ারি মাসে বিপ্লবের বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে বিরোধীরা জমায়েত করে বিভিন্ন শহরে। মোরসির বাড়ির সামনে প্রচুর মানুষ জড়ো হয় তার উৎখাত চেয়ে। জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে একটি ফুটবল দাঙ্গার বিচারকে কেন্দ্র করে পোর্ট সইদ শহরে জনবিদ্রোহ হয়। চলতে থাকে পুলিশের অত্যাচার। কায়রো, পোর্ট সইদ, আলেকজান্দ্রিয়া থেকে শুরু করে অন্যান্য ছোটো বড়ো শহরে বিক্ষোভ হতে থাকে। মোরসির পার্টি মুসলিম ব্রাদারহুড এবং বিরোধীদের সংঘর্ষে এবং পুলিশি নিপীড়নে জানুয়ারি মাসে প্রায় পঞ্চাশ জনের মৃত্যু হয়। সারা মিশর জুড়ে পুলিশি সন্ত্রাস বাড়তে থাকে। রাজধানী শহর কায়রোতে মহিলাদের ওপর শাসকদল মুসলিম ব্রাদারহুডের ক্যাডারদের হামলা, এবং তাহরির স্কোয়ারে জমায়েত হওয়া প্রতিবাদী মহিলাদের শ্লীলতাহানির ঘটনা বাড়তে থাকে। ৬ ফেব্রুয়ারি তাহরির স্কোয়ারে মহিলাদের ওপর যৌনহিংসার প্রতিবাদের বিক্ষোভ মিছিল হয়। বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশি নিপীড়নের ছবি দেশের প্রধান বেসরকারি মিডিয়া প্রচার করলে বিরোধীদের বিক্ষোভের আগুন জনমানসেও ছড়িয়ে পড়তে থাকে। মুবারক জমানার পুলিশি অত্যাচারের স্মৃতি ফিরে আসে।
মার্চ মাসে বন্দর শহর পোর্ট সইদে ফের জনবিদ্রোহ হয়। ৩ মার্চ কয়েদিদের ছাড়াতে আসা জনতার সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে তিনজন পুলিশ এবং দু-জন বিক্ষোভকারী নিহত হয়। পরে আরেকটি ঘটনায় রাজধানী কায়রোর তাহরির স্কোয়ারের কাছে তিনজন বিক্ষোভকারীকে গুলি করে মারে পুলিশ। মে মাসে প্যালেস্তাইনের নিকটবর্তী সিনাই প্রদেশে সশস্ত্র হামলা শুরু হয়। মিশরের মোরসির শাসন দুর্বল হতে থাকে, কিন্তু বিরোধীদের আন্দোলনও জমি পাচ্ছিল না। রাস্তায় নেমে প্রচুর প্রতিবাদ হওয়া সত্ত্বেও তা জনবিপ্লবের আকার নিচ্ছিল না।
এপ্রিল মাসের শেষের দিকে পাঁচজন আন্দোলনকারী ‘তামারুদ’ (আরবি ভাষায় এই শব্দের বাংলা মানে বিদ্রোহ) নামে একটি প্রচার শুরু করে। এদের মধ্যে অন্যতম একজন মাহমুদ বদর, যিনি মুবারক জমানার বিরুদ্ধে আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্বদায়ী ‘কেফায়া আন্দোলন’-এর একজন সংগঠক, একটি ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রযোজক এবং সাংবাদিক)। তামারুদ একটি সাধারণ সই সংগ্রহ অভিযান, মোরসির উৎখাত এবং নয়া প্রেসিডেন্সিয়াল ভোট চেয়ে। এক পাতার এই সই-সংগ্রহের বয়ানটি এরকম :
আমরা তোমাকে প্রত্যাখ্যান করছি, কারণ এখনও মানুষের নিরাপত্তা ফিরে আসেনি।
আমরা তোমাকে প্রত্যাখ্যান করছি, কারণ এখনও বঞ্চিত মানুষদের জন্য কোনও বন্দোবস্ত হয়নি।
আমরা তোমাকে প্রত্যাখ্যান করছি, কারণ এখনও আমরা বাইরে হাত পাতছি ঋণ চেয়ে।
আমরা তোমাকে প্রত্যাখ্যান করছি, কারণ শহীদরা এখনও ন্যায়বিচার পায়নি।
আমরা তোমাকে প্রত্যাখ্যান করছি, কারণ আমি বা আমার দেশ, কারোরই কোনও সম্মান অবশিষ্ট নেই।
আমরা তোমাকে প্রত্যাখ্যান করছি, কারণ আমাদের অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে, আমরা ভিক্ষের ওপর বেঁচে আছি।
আমরা তোমাকে প্রত্যাখ্যান করছি, কারণ এখনও মিশর আমেরিকায় কথায় চলছে।
মোহাম্মদ মোরসির আগমনের সময় থেকে আজ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের ভাবনা হচ্ছে, বিপ্লবী লক্ষ্যের কোনও কিছুই অর্জিত হয়নি। পাওয়া যায়নি সম্মানজনক জীবন, মুক্তি, সামাজিক ন্যায়, এবং জাতীয় স্বাধীনতা। এগুলির একটিও পূরণ করতে মোরসি সম্পূর্ণ ব্যর্থ। …
তাই আমরা নিম্নের স্বাক্ষরকারীরা মিশরীয় নাগরিক হিসেবে মোরসির পদত্যাগ ও প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন চাইছি। আমি বিপ্লবের লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থেকে বিদ্রোহী প্রচার এবং সম্মানজনক জীবন, ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতার ওপর প্রতিষ্ঠিত সমাজ অর্জনের জন্য কাজ করব।
এই প্রচারে স্বাক্ষরকারীদের ১৪ সংখ্যার জাতীয় পরিচয়পত্রের নাম্বারও দিয়ে দিতে বলা হয়েছিল। এই প্রচার কিছু বিপ্লবী কর্মী শুরু করলেও অচিরেই বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি এই প্রচারে জুড়ে যায়। এই সই-সংগ্রহ অভিযান ব্যাপক সাড়া পায়। ৩০ জুনের মধ্যে দেড় কোটি সই সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল, ওঠে ২ কোটির ওপরে সই। মোরসির মুসলিম ব্রাদারহুড পাল্টা সই সংগ্রহ শুরু করে, এবং দাবি করে, তারা এক কোটির ওপরে সই সংগ্রহ করেছে।
২৬ জুন সরকারি মিডিয়াতে মোরসি আড়াই ঘন্টা ধরে ভাষণ দেন। কিন্তু সেই ভাষণে বিরোধী দলগুলিকে হুমকি দেওয়া ছাড়া কার্যত কিছু না থাকায় বিরোধীরা একজোটে ৩০ জুন মোরসির সিংহাসনের আরোহনের এক বছর পূর্তির দিনেই জনবিক্ষোভের ডাক দেয়।
৩০ জুন কায়রোর ১৮টি শহরে বিক্ষোভ হয়। প্রায় সমস্ত বিরোধী শক্তি এই বিক্ষোভে যোগ দেয়। কারও মতে, কায়রো, আলেকজান্দ্রিয়া, আল মাহাল্লা প্রভৃতি শহরে মোট দেড় কোটি মানুষ ওইদিন রাস্তায় নেমেছিল। যদি তা সত্য হয়, তাহলে এটি ছিল মিশরের ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো জনবিক্ষোভ। মুসলিম ব্রাদারহুডের অফিস ভাঙচুর হতে থাকে। জুলাই মাসের শুরুতে মোরসি-সমর্থকদের ওপর বন্দুক হামলা শুরু হয়। ৩ জুলাই মিশরের সেনাবাহিনী মোরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে। নয়া সংবিধান বাতিল ঘোষণা করে এবং প্রধান বিচারপতি আদিল মনসুরকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে। মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থক ও নেতাদের গ্রেপ্তার করে সেনাবাহিনী। বেশ কিছু মোরসি সমর্থক নিহত হয়। ব্রাদারহুডের টিভি চ্যানেল বন্ধ হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক টিভি আল জাজিরার সম্প্রচারও বন্ধ করে দেওয়া হয়।
আমেরিকা ও ইউরোপের বড়ো বড়ো দেশগুলি মিশরের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। কেউই মোরসির উৎখাতে খুশি হয়নি।
Leave a Reply