কৃষ্ণেন্দু মণ্ডল, ব্যাতাইতলা, ১২ নভেম্বর#
শহর, শহরতলি সর্বত্রই ফ্ল্যাট বাড়ি গজাচ্ছে। বহুতল, শপিং মল, কমপ্লেক্স, মাল্টিপ্লেক্স, জি+৪, জি+৭ — এগুলো এখন চেনা শব্দ। ‘নবান্ন’র কাছে ব্যাতাইতলা অঞ্চলও তার ব্যতিক্রম নয়।
বিদ্যাসাগর সেতুর টোল ট্যাক্স পেরিয়ে বাঁদিকের একটা লেন ধরে গড়িয়ে নেমে এলেই ডানদিকে নবান্ন বাস-স্ট্যান্ড। নবান্ন বাস-স্ট্যান্ডের উল্টোদিকেই কোনাকুনি ফ্লাই-ওভার সংলগ্ন রাস্তার গা ঘেঁষে গজিয়ে ওঠা ছোট্ট একটা মার্বেলের শিব মন্দিরের পাশ দিয়ে ঢুকলে ‘ওঙ্কারমন জাটিয়া রোড।’ এই রাস্তায় ঢুকতেই বাঁদিক ধরে সাইকেল সারাইয়ের দোকান, চায়ের দোকান, তারপরেই বহুপুরোনো পীরের দরগা — আগের দৃশ্যমানতা আর নেই। এখন মার্বেল মোড়ানো নতুন কাঠামো। তার পাশে মজা পুকুর, জঙ্গলাকীর্ণ সৈয়দদের কবরস্থান, ওঙ্কারমন জাটিয়া রোড ধরে হেঁটে ডানদিকে সর্বমঙ্গলা কালীমন্দিরকে রেখে এগিয়ে গেলে প্রায় শেষপ্রান্তে বিস্তৃত জায়গা জুড়ে ছিল এক বুড়োর বাগান। এক নিঃসন্তান বুড়ো ব্যবসায়ীর প্রাণের শান্তি মনের আরাম ছিল এই বাগান। মানুষটির নাম ওঙ্কারমন জাটিয়া। এই অঞ্চলের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, হাওড়া ফ্লাওয়ার মিলের মালিক ছিলেন ইনি।
তাঁর নামেই রাস্তার নাম। বাগানে ছিল পাথরের পরী, ফোয়ারা, ছোটো পাহাড়, ঝরনা অঙ্কিত ঘর আর ছিল অজস্র গাছ, এক জলাশয় — তাতে স্বচ্ছ কাঁচের মতো জল। বুড়ো এসে বসত বাগানে, ফুল ফুটত, পাখি আসত বুড়োকে গান শোনাত। পুরোনো দিনের সিনেমা ‘আলিবাবা-চল্লিশ চোর’-এর শ্যুটিং হয়েছিল এখানে। এখনও টানা প্রাচীরের ধার ধরে ধরে অনেক গাছ — নারকেল-আম-জাম-নিম-লিচু মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু বাগানের ভিতরটা অনেকদিনই ফাঁকা হতে হতে একবারে ন্যাড়া মাঠ। এখন চলেছে ময়-দানবের বিশাল কর্মযজ্ঞ। হবে জি+৭ কমপ্লেক্স ‘এক হাত লক্ষ্মী গার্ডেন’। ব্যাতাইতলার দিকের ব্রিজ ধরে নামতে নামতে বাঁদিকে চোখে পড়ে কংক্রিটের পিলার উঠছে। ছাদ ঢালাই হচ্ছে তার ধারে জড়ো করা মাটির ঢিবি। একদিকে একটা ঝাঁঝড়া গাছ, আর একদিকে পাতা ঝরে যাওয়া একটা কঙ্কালসার গাছ বাগানের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। উল্টোদিকে ব্রীজের ডানদিকে রাস্তার গায়েই যে ‘শান্তিকুঞ্জ’ নামের বিশালাকার হাউজিং কমপ্লেক্সটা গড়ে উঠেছে সেখানেও ছিল বাগানের এক অংশ। কয়েকবছর আগে জীবনকৃষ্ণ ক্লাবের ছেলেরা ঝগড়া লড়াই করে এক চিলতে ফুটবল মাঠ আদায় করে, সেটুকুই যা টিকে রইল।
ব্যাতাইতলা ফাঁড়ির দিকে বেরিয়ে এসে জিটি রোড ধরে ব্যাতাইতলা বাজারের দিকে যেতে বাঁদিকে ঢুকছে শরৎ চ্যাটার্জি রোড, তার মুখেই গড়ে উঠেছে এক কমার্শিয়াল কমপ্লেক্স। শুনছি বেসমেন্টে হবে কার পার্কিংয়ের জায়গা। একসময় ওখানে ছিল ত্রিপল ফ্যাকট্রি, বছর বিশেক আগেই বন্ধ হয়ে যায়। চোখে পড়ত এক বিশাল আমগাছ, প্রতি মরশুমে ফলে ভরে উঠত — আর দু-একটা গাছও ছিল। নাম দিয়েছে ‘শান্তিসদন’।
শরৎ চ্যাটার্জী রোড ধরে নতুন পল্লির — ভেতরে মণিলাল চ্যাটার্জি লেনের দিকে যেতে কানাগলির শেষপ্রান্তে ছিল সুন্দর একতলা বাড়ি। বাড়ির উঠোনে ‘পাতকূয়ো’। বাড়িটাকে দেখতে দেখতে ‘প্রান্তিক’ ছাড়া আর কোনো নাম মনে আসত না। বাড়িটা নেই হয়ে গেল। হ্যাঁ তা প্রায় চারতলা ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি হয়ে এল।
নতুন পল্লির ভেতরেও একের পর এক পুরোনো বাড়ি ভাঙছে, গড়ে উঠছে নিত্য নতুন ফ্ল্যাট। যেখানে ধুনমুন চৌধুরী ও তার সঙ্গীরা দলীয় পতাকা বিহীন আন্দোলন করছিলেন সেখানেও একদিকে পাঁচতলা ফ্ল্যাট বাড়ি উঠছে। ধুনমুন বললেন, ওদের সঙ্গেও বোঝাপড়া হয়েছে, কথাবার্তা চলছে, ফ্ল্যাটবাড়ি হলে ওরাও ফ্ল্যাট পাবে।
বাড়ির চেহারা বদলায়, নাম বদলায়, তাই হরিভবন, মাতৃভবন, পিতৃভবন এইসব নামের জায়গায় লক্ষ্মী গার্ডেন, শান্তিকুঞ্জ, শান্তিসদন, কল্পতরুই এখন বাজার চলতি ধারা। \par
অবশ্য নামে কী-ই বা আসে যায়? আমাদের পাড়ায় এক প্রাসাদোপম বাড়ি, তার নাম ‘সেঁজুতি’। এক সন্ধ্যেয় রুটি কিনতে গিয়ে মনসাতলায় চোখে পড়ল এক সুদৃশ্য বাড়ি। বাড়ির বারান্দা থেকে টব উপচে পড়া লতানো গাছ। কাছে গিয়ে কলকে দেখি — ‘বাবুইবাসা’।
বাবুইবাসা লিখতে মনে পড়ল, আমার বাবার দিদিমা কলকাতা থেকে যাওয়া নাতবউকে (আমার মাকে) দেখানোর জন্য এক বাবুইবাসা এনে হাজির করেছিলেন। কুলুঙ্গিতে রাখা ছিল, ছোটোবেলায় দেখেছি। মায়ের সেই দিদি-শাশুড়ি, মা তাঁর চিকিৎসা করাতে চাইলে বলতেন ‘নাতবউ! এই পুরোনো কাঠামোয় আর কিছু হবার নয়।’
সত্যিই তো! আমার বাড়ির পূর্বদিকে, পীরের ডাঙার পাশে ছিল ‘ধোপার মাঠ’ আর এক বড়ো পুকুর। ধোপারা সকাল থেকে ধপাস্-সাই কাপড় কাচত এখন সেখানে চারতলা ফ্ল্যাট-বাড়ি ‘বসুধা’।
গঙ্গার ওপারে ডালহৌসি স্কোয়ারেও এপারের ফ্ল্যাটের বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। কোনোটা হবে ‘শালিমার’-এ, কোনোটা ‘ফোরশোর রোড’-এ। পুরোনো কাঠামোয় আর কিছু হবার নয়। তাই তো শহর জুড়ে নতুন কাঠামো — নতুন নির্মাণ!
বুড়োর বাগান, ধোপার মাঠ
জলা জমি, পুকুর ঘাট
সব গেল সব গেল
গঙ্গার তীর পশ্চিমে
পূবে নয় পশ্চিমে,
নতুন সূর্য উন্নয়ন!
উন্নয়ন!
Leave a Reply