রামজীবন ভৌমিক, কোচবিহার, ৩০ আগস্ট#
কোচবিহার শহরে রিক্সা এক নতুন সমস্যার মুখে পড়েছে। ২৮ আগস্ট এই নিয়ে তারা ডিএম অফিসে ডেপুটেশন দিয়েছে।
এমনিতেই শতশত পায়ে ঠেলা রিক্সা শ্রমিকদের পেশাগত সমস্যা অনেক। বৃষ্টিতে ভিজে রোদে পুড়ে সওয়ারিকে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে দিতে হয়। বেশিরভাগ রিক্সা শ্রমিকদের নিজের রিক্সা নেই। রিক্সা ভাড়া খাটানো ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রাত্যহিক ৪০-৫০ টাকা ভাড়ায় রিক্সা ধার নিয়ে দিনভর চালাতে হয়। কোচবিহার পৌরসভা ২০০৯ সালের পর নতুন করে ভাড়ার তালিকা প্রকাশ করেনি। কোচবিহার শহরে সওয়ারী-রিক্সাচালকের মধ্যে ভাড়া নিয়ে কাজিয়া নিত্যসঙ্গী। শহরের রিক্সা দাঁড়ানোর মোড়গুলি এখন ব্যবসায়িক স্থান। পৌরসভার সাহায্যে প্রোমোটার ব্যবসায়ীরা সেই সব জায়গায় দোকান-রেস্তরাঁ খুলে বসছে বা বসতে চাইছে। রিক্সা স্ট্যান্ডগুলি একে একে জোর করে তুলে দেওয়া হচ্ছে।
শহরের লোকসংখ্যা বাড়ছে। রিক্সা শ্রমিকও বেড়েছে। সারা দিনে জমিতে খেটে সন্ধ্যের পর শহরে রিক্সা চালাতে আসে অনেক পায়ে টানা রিক্সা শ্রমিক। কিন্তু পৌরসভা থেকে রিক্সা চালানোর লাইসেন্স পাওয়া সহজ কাজ নয়। আবার লাইসেন্স সাথে না নিয়ে রিক্সা চালালে পৌরসভা তিনশত টাকা করে ফাইন তোলার ঘটনা অহরহ ঘটাচ্ছে। একটু বেশি রাত হলেই কোনো মাতাল রিক্সা দাঁড় করিয়ে টাকা চাইছে বা শরীরী নিগ্রহ ঘটাচ্ছে- এই দৃশ্য সওয়ারি হিসেবে আমার নিজে চোখে দেখা।
নতুন যে সমস্যা এসেছে — সেটা এই পেশাটির অস্তিত্ত্বই অবলুপ্ত করতে যাচ্ছে। ব্যাটারীচালিত রিক্সা। ধোঁয়াহীন, শব্দহীন, চারিদিক খোলা ব্যাটারিচালিত রিক্সা দ্রুত সওয়ারিকে গন্তব্যে পৌঁছে দিচ্ছে। উত্তরবঙ্গ জুড়ে কয়েকশো ব্যাটারিচালিত রিক্সা বেশ মানিয়ে নিয়েছে। কোচবিহারে কয়েকমাসের মধ্যেই ৩৫টি ব্যাটারিচালিত রিক্সা শহরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছে। আরও শ-খানেক নামবে নামবে করছে।
প্রশ্ন হল, এদের রাস্তায় রিক্সা চালাবার অনুমতি কে দিল? ভাড়া নিচ্ছে ১৫-২০-৩০ টাকা করে। এটা কে নির্ধারণ করল? জেলা শাসকের দপ্তর? নাকি পৌরসভা? প্রশ্নগুলো সহজ হলেও উত্তর নেই কোথাও। পায়ে টানা রিক্সা চালকেরা ওপরের সব ক-টি শর্ত পূরণ না করলে ফাইন হয়। এদের ফাইন হচ্ছে না কেন?
ক্ষোভ দুঃখ দুটোই পায়ে টানা রিক্সা শ্রমিকদের ভারাক্রান্ত করেছে। সামনে পূজা, সওয়ারি টানার বাড়তি ব্যবসা থেকেই অনেক সাংসারিক দায় মেটাবে বলে সারা বছর অপেক্ষা। সে ব্যবসা তো গেলই সাথে পেশাটাই না পুজোর আগে উবে যায়।
২৮ আগস্ট কোচবিহার ডিএম অফিসে কয়েকহাজার রিক্সা শ্রমিক তাদের পেশাগত সমস্যা নিয়ে ডেপুটেশন দেয় বেলা ২টায়। স্থানীয় বড়োদেবীর মন্দির মাঠ থেকে বেলা একটায় সুশৃঙ্খলভাবে শুধুমাত্র একটি লাইনে শতশত রিক্সা বেরিয়ে পড়ে। মিছিল সাগরদিঘির আমতলা মোড়। শহিদবাগ মোড়, কাছারি মোড় হয়ে মিনিবাস স্ট্যান্ডের দিকে যায়। সেখান থেকে বাদুর বাগান মোড় হয়ে আবার শহিদবাগ মোড় হয়ে ডিএম অফিসের দিকে আসে। যানজট তৈরি হয়নি। পথচলতি মানুষদের চলাফেরায় বাধা না দিয়েই মিছিল এগিয়ে চলেছে। একটি রিক্সায় মাইকে স্লোগান চলছিল।
সুপারিন্টেনডেন্ট অফিসের সামনের রাস্তায় মিছিল আসতেই কিছু পুলিশ এসে জোর করে স্লোগান থামিয়ে দেয়। মাইকের তার খুলে দেয়। রিক্সা শ্রমিকেরা ফুঁসতে ফুঁসতে ডিএম অফিসে প্রবেশ করে। কোচবিহার জেলা সংগ্রামী রিক্সা শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষে বক্তব্য রাখেন পূর্ণেন্দু দে। তিনি বলেন, ‘পায়ে টানা রিক্সাচালকদের সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে ব্যাটারিচালিত রিক্সা কেনার ব্যবস্থা করতে হবে। রিক্সাচালকদের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। ব্যাটারিচালিত রিক্সা ও পায়ে টানা রিক্সা শ্রমিকদের দ্বন্দ্বের সুষ্ঠু সয়াধান করতে হবে।
পূর্ণেন্দুবাবু বলেন, উত্তরবঙ্গ জুড়ে এই দ্বন্দ্ব দিন দিন বেড়েই চলেছে। একটা অপ্রীতিকর পরিবেশ রাস্তায় গড়ে উঠেছে। কিন্তু সরকারি স্তরে এই দ্বন্দ্বের সুষ্ঠু সমাধানের প্রচেষ্টা নেই। বড়ো রাজনৈতিক দলগুলির কাছে এটা কোনো সমস্যা হয়ে ওঠেনি। শতশত পায়ে টানা রিক্সা শ্রমিকের পেটে লাথি মেরে আমাদের জীবন শেষ করে দিলে আমরা বৃহত্তর আন্দোলনে যাব। কারণ আমরা সুপথে রোজগার করেই বাঁচতে চাই।’
Leave a Reply