তাপস দাস, গৌহাটি, আসাম, ৩০ জুলাই##
১৯৬২ সালে বোড়ো ভাষার দাবিতে একটা বড়ো আন্দোলন হয়। দাবি ছিল বোড়ো ভাষাকে মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালিয়ে বোড়ো যুবকদের হত্যা করে। ণ্ণপ্লেন্স ট্রাইবাল কাউন্সিল অব আসাম’ নামে একটি জনজাতি সংগঠন গড়ে উঠেছিল আসামে, তাদের নেতৃত্বেই আন্দোলনটা হয়েছিল। পরবর্তীকালে এই আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৫ আসাম আন্দোলন হল। তখন বোড়ো বা জনজাতিরা আসাম আন্দোলনকেই সমর্থন করেছিল।
কিন্তু ণ্ণঅল আসাম স্টুডেন্ট্স ইউনিয়ন’ থেকে ণ্ণঅসম গণ পরিষদ’ হয়ে যখন সরকার গঠন করল, তখন এরা জনজাতি বা ট্রাইবদের ইস্যুগুলোকে গুরুত্ব দিল না। ১৯৮৭ সাল থেকে বোড়োরা পৃথক বোড়ো রাজ্যের দাবি করল। ণ্ণঅল বোড়ো স্টুডেন্ট্স ইউনিয়ন’ বা আবসু-র নেতৃত্বে একটা আন্দোলন গড়ে উঠল। পুলিশ ও সামরিক প্রশাসন গ্রামের পর গ্রাম গুলি চালিয়ে ফাঁকা করে দেয়। ভয়ঙ্কর অত্যাচার নামে। ১৯৯৩ সালে একটা সংঘর্ষ হয়, বোড়ো বনাম সাঁওতাল। কারণ ওই সময় একটা চুক্তি হয়েছিল সরকারের সঙ্গে, তাতে নির্দিষ্ট কোনো এলাকা বা টেরিটরি ভাগ ছিল না। তখন প্রায় দু-লাখ সাঁওতাল, মুণ্ডা, আদিবাসীরা চল্লিশটা সরকারি শিবিরে ছিল। ওই চুক্তি টিঁকল না। পরবর্তীকালে আবসুর জায়গায় এল বোড়ো লিবারেশন টাইগার বা বিএলটি। এদের নেতৃত্বে একটা বড়ো আন্দোলন হয়েছিল। ২০০৩ সালের ৬ ডিসেম্বর বিএলটি অস্ত্র নামিয়ে নেয় এবং শান্তির পক্ষে রায় দেয়। ২০০৩ সালে ১০ ফেব্রুয়ারি সরকারের সঙ্গে চুক্তি হল। ণ্ণবোড়োল্যান্ড টেরিটরিয়াল এরিয়াজ ডিস্ট্রিক্ট’ তৈরি হল। স্বশাসিত ণ্ণবোড়োল্যান্ড টেরিটরিয়াল কাউন্সিল’ কিছু ক্ষমতা পেল।
এই কাউন্সিলের এলাকার মধ্যে কতকগুলো গ্রাম ঢুকেছে, কতকগুলো ঢোকেনি। বোড়ো অধ্যুষিত অঞ্চলে ২০১১ সালে দেখা যাচ্ছে, কোকরাঝাড় বাকাসা চিরাঙ্গ ও উদালগুড়ি মোট চারটি জেলায় ৩১ লক্ষের কিছু বেশি। ২০০১ সালে ছিল এর ৫০%। এই বোড়ো অধ্যুষিত অঞ্চলের ৩০০০-এর বেশি গ্রামের মধ্যে ৯৫টা গ্রামে ১-২% বা তারও কম বোড়ো জনজাতির লোক আছে। এইসব গ্রামে বোড়ো বনাম অ-বোড়ো দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। এই অ-বোড়ো সম্প্রদায়ের মধ্যে আদিবাসী সাঁওতাল-মুণ্ডা আছে, রাভা আছে, কোচ-রাজবংশী আছে, মুসলমান আছে, ৩০-৪০-৫০ বছর আগে আসা বাংলাদেশের মানুষও আছে।
এদিকে বোড়োরা আরও কিছু গ্রাম তাদের অঞ্চলের মধ্যে চাইছিল। আদিবাসী বনাম জনজাতি একটা সংঘাত আগে থেকেই ছিল। ণ্ণঅল আসাম মাইনরিটি স্টুডেন্ট্স ইউনিয়ন’ বা আমসু-র নেতৃত্বে মুসলমানরাও নিজেদের বঞ্চনা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছিল। ফলে বোড়ো বনাম অ-বোড়ো সংঘাত বাড়ছিল। বোড়োরা পৃথক বোড়োল্যান্ডের দাবি করছিল।
গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনে যেমন আরও গ্রাম, আরও এলাকার দাবি এসেছে, একই জিনিস বোড়োল্যান্ড আন্দোলনেও দেখা গেছে। তবে গোর্খাল্যান্ডের ক্ষেত্রে যেমন অ-গোর্খার বিপরীতে বাঙালি, এখানে অ-বোড়ো সমাজের কৌমগুলোকে ভাগ করা যায় না। রাভারাও আলাদা টেরিটরির দাবি করেছে। সেখানে রয়েছে রাভা বনাম অ-রাভা দ্বন্দ্ব। কিন্তু অ-বোড়ো কিংবা অ-রাভা গোষ্ঠীগুলোকে নির্দিষ্টভাবে আলাদা করা যায় না। একসময় হয়েছিল বোড়ো বনাম সাঁওতাল সংঘর্ষ। এখন দেখা যাচ্ছে বোড়ো বনাম মুসলমান দ্বন্দ্ব।
একথা অনস্বীকার্য, বোড়ো জনজাতি নানানভাবে বঞ্চিত হয়েছে। ভাষার বঞ্চনা তো রয়েছেই। একটা লম্বা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ২০০৩ সালে বোড়ো ভাষা সরকারি স্বীকৃতি পেয়েছিল। এটা একটা দিক। অন্যদিকে আজ ওরা অন্যদের বঞ্চনার বিনিময়ে কিছু অধিকার চাইছে। একটা সময় আইন ছিল, ট্রাইবদের এলাকায় অ-ট্রাইবরা থাকতে পারবে না। পরে সেটা সংশোধন হল, অ-ট্রাইবরা ট্রাইবাল এলাকায় জমি কিনতে পারবে। একসময় বোড়োরা সরল সাদাসিধে ছিল। কোনো বোড়ো গাঁওবুড়াকে গিয়ে অন্য গোষ্ঠীর মানুষ যদি বলত, আমি খেতে পাচ্ছি না, তাকে বলা হত, যা পাঁচ বিঘা জমি নিয়ে থাক। কেউ বলল, গরু নাই, তাকে একজোড়া হালবলদ দিয়ে দেওয়া হল। কিন্তু পরে অর্থনৈতিক সঙ্কট বাড়ল। জমির চাহিদা বেড়ে গেল। আজ বলা হচ্ছে, তোমরা চলে যাও।
এবারকার সংঘর্ষে এককভাবে বোড়োদের দায়ী করা যায় না। মুসলমান সম্প্রদায়ও সমানভাবে দায়ী। ওরাও হত্যা কম করেনি। কে কতটা আগ্রাসি, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। বোড়োদের হাতে আর্ম্স আছে। মুসলমানদের হাতে আর্ম্স নাই, তাদের হাতে ছুরি, দা, কাটারি। তারা সশস্ত্র লড়াই করেনি। বোড়োরা করেছে। ফলে এরা বড়ো ধরনের তাণ্ডব চালিয়েছে। আবার ধুবড়ি জেলায় যেখানে বোড়োরা সংখ্যালঘু, সেখানে মুসলমানরা গ্রাম পুড়িয়ে ছারখার করেছে। অতএব দাঙ্গাহাঙ্গামা একতরফা হয়নি। শিবিরে অসহায় অবস্থায় রয়েছে চল্লিশ হাজার বোড়ো। আর অ-বোড়ো শিবিরে রয়েছে প্রায় দু-লক্ষ মানুষ। কেন এই দাঙ্গা হল? নানান ধরনের প্রশ্ন মানুষের মনে আসছে। নানান ধরনের স্বার্থ এখানে উসকানির কাজ করেছে। তবে যারা সংবাদ নিতে যায়, তারা কেউই সংঘাতের কেন্দ্রগুলোতে যায় না। যতখানি গা বাঁচিয়ে রিপোর্ট করে।
Leave a Reply