সঞ্জয় ঘোষ, জয়নগর মজিলপুর, ৩১ মে#
মজিলপুরের কালীর বেশের মেলাকে এখন গ্রাম্য মেলা বলা যাবে না। কারণ এই মেলায় গ্রাম্য কারিগরদের হাতে তৈরি জিনিস ক্রমশই কমছে। জায়গা নিচ্ছে কারখানায় তৈরি নানান জিনিসপত্র। সাধারণ মেলাগুলোতে গ্রাম্য ছুতোরদের তৈরি কাঠের নানা আসবাবপত্রই বেশি জায়গা নেয়, কিন্তু এখানে আসবাবপত্রের কোনো স্টল থাকে না। রকমারি মনোহারি জিনিসের দোকানই বেশি। তবে তার মধ্যেও আমার ভীষণ লোভ লাগে সিউড়ি শিল্প প্রতিষ্ঠানের নানারকমের আচার, মোরব্বা, হজমি, পাচক, পানপোর, কাসুন্দি ইত্যাদির স্টল দেখে। বাঙালির এই শিল্পটির বৈচিত্র্য দেখে অবাক হতে হয়। কী নেই এখানে। স্টলের ওপরে সব লেখা আছে আর স্টলের সামনে সারি সারি সাজানো বয়াম থেকে গন্ধ বেরোচ্ছে।
এত অদ্ভুত জিনিসের আচার হতে পারে, আমার জানা ছিল না। যেমন, বৃন্দাবনের বাঁশের আচার, রসুনের আচার ইত্যাদি ১২ রকমের। আবার ওই স্টলটাতেই একদিকে লেখা রয়েছে কল্যাণী শিল্প প্রতিষ্ঠান। তার তলায় লেখা চিংড়ি মাছের পানপোর। এও হয় নাকি? দেখে খুব অবাক লাগে। আমের পানপোর, মেদিনীপুরের গহনা বড়ি, ডালিমের হজমি, মুগ ডালের ৬ ধরনের বড়ি, জোয়ান পাচক, হিং মশলার বড়ি, পোস্তর বড়ি। স্টলের কর্মচারী বলল, ২৫ বছর এই মেলায় আসছে। এদের বাড়ি কল্যাণীতে। সিউড়ি থেকে আচার ইত্যাদি এনে বিক্রি করে নিজেদের তৈরি জিনিসের সাথে। মায়ের পুকুর বা পদ্ম পুকুরে উত্তর দিকে ওষুধ দোকানের উল্টোদিকে বরাবর বসে এরা। এবার দেখলাম দুটো স্টল এই রকম। অন্যটা বছর দু-তিন আসছে।
মূর্শিদাবাদ থেকে কাঠের বেলন চাকি ইত্যাদি নিয়ে যারা প্রতিবারই ওই পুকুরের দক্ষিণ কোণে বসে তারাও এসেছে। খাজা, গজা, জিলিপির লোভনীয় সম্ভার ছাড়া মেলা হয় নাকি? এরকম দোকান ৪-৫ টা, নির্দিষ্ট জায়গাতেই। কিন্তু তাদেরকে ছাপিয়ে গেছে অন্নপূর্ণা, গৌরাঙ্গ নামের বিরাট বিরাট রেস্টুরেন্ট। সেখানে চেয়ার টেবিলে পাতা। মেলার সব চাইতে বড়ো দোকান এইগুলোই। নানান বিদেশি খাবারের নাম ওপরে লেখা। সামনে স্তুপাকার ঢাকাই বাকরখানি বলে লুচির মত চেহারার, কিন্তু বেশ বড়ো আকারের। এসব মেলা দেখতে আসা ক্ষুধার্ত মানুষকে আকর্ষণের কৌশল। অনেক লোক বসে খাচ্ছেও।
তবে মেলায় সব থেকে আওয়াজ আর হৈ চৈ হয় বাকের মাঠে মরণ কূপে। সেখানে বিপজ্জনক ভাবে মোটর সাইকেল ঘোরে। আছে মিউজিয়াম। বাইরে নানান সব বিচিত্র প্রাণীর ছবি থাকে। আর রয়েছে মেলার সবথেকে উঁচু আকর্ষণ ইলেকট্রিকে চলা দৈত্যাকার নাগরদোলা, ধন্বন্তরী যাত্রীনিবাসের সামনের মাঠে। পাশেই ইলেকট্রনিকের মজাদার বিশাল ঘূর্ণায়মান জয় রাইডের পাশে ময়ুরমুখো ট্রেন চলছে। ছোটো বড়ো যাত্রী নিয়ে প্রায় চৌকো লাইন ধরে। আগেকার খুব ছোটো নাগরদোলাগুলো কয়েকটা এদের ফাঁকে ফাঁকে তাদের ক্ষীণ অস্তিত্ব বজায় রেখেছে এখনও কোনোরকমে। মন্দিরের চাদনির পাশে মায়ের পুকুরের দিকে মুখ করে বরাবরের মতো তিনটে কামারের স্টলই বোধ হয় সবথেকে ভালোভাবে গ্রাম্য কারিগরদের প্রতিনিধিত্ব করছে। এই মেলায় ওদের প্রয়োজনীয়তা ফুরোয়নি, যদিও জৌলুষহীন লাগছে অন্যান্য সব দোকানের পাশে।
Leave a Reply