সকাল ৮টা বা বড়ো জোর ৮টা ৩০ বাজে, আগের দিন রাতে ভালো ঝড়বৃষ্টি হয়েছে। রাস্তায় ভিজে ভাব। সাতসকালে রোদ্দুর খুব চড়া, তার মধ্যেই আজ নীলের পুজোয় বাতি দেবার জন্য লোকে রাস্তায় বেরিয়েছে। যারা হাট সন্ন্যাস বা তার আগের দিন সন্ন্যাস নিয়েছে রাস্তায় তাদের আনাগোনা। ফলতার শ্যামসুন্দরপুরের নীলের মেলায় লোকে লোকারণ্য। হুগলি নদীতে চান করে নদীতে আম ছুড়ে উৎসর্গ করা হয় গঙ্গাকে, আজ থেকে শুরু হল আম খাওয়া। এইসব দেখতে দেখতেই পথ চলা।
এই ফলতারই অন্য এক গ্রাম বিশ্বনাথপুর, ফলতা ব্লকের পিছিয়ে পড়া গ্রাম ন’পুকুরিয়ার কাছাকাছি। এই অঞ্চলের পুরোনো ইতিহাস বলে, পঞ্চাশের দশকে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির লড়াই আন্দোলন বা তারও আগে ১৯৪৪-এ মহিরামপুরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক কমিটির লড়াইয়ের ইতিহাস বলে দিঘীরপাড়ের পাশের গ্রামগুলির মানুষের জলকাদা ভেঙ্গে এগিয়ে আসার কথা। আজ এইসব অঞ্চলের কিছু জিনিস বদলেছে আর দারিদ্র বাইরের চেহারায় বদলালেও ভিতরে একই আছে। ধান চাষের সার্ভে করতে আসা, কেন আর কী বৃত্তান্ত এসব চুকিয়ে আলাপ উঠল জমে। কথা বলতে বলতে কাজ করছে বছর পঁচিশের যুবক। মশারি তৈরির কাজ চলছে। পাশেই মসজিদের সামনে রাখা ঘড়ি বলছে বেলা গড়াচ্ছে।
ধান চাষ কেমন চলছে জিজ্ঞেস করায় বলল, সামনের রাস্তার ওপারে হরিশপুরের খাল দিয়ে জল আসে বলে ওপারে চাষ চলছে, তা না হলে এই খোরোতে জল কিনে চাষ অসম্ভব। তার ওপর আছে সার আর বিষের দাম। বলে, তোমাদের বর্ণের লোকেরাই এখন বড়ো করে চাষ করে। আমি বলি তা কিন্তু ঠিক নয়। আসলে যে জমি ঘরযোগে (বউ ছেলে মেয়ে সবাই নিয়ে) মাঠে খাটতে পারে সেই চাষ করছে। ও একমত হয়। বলে, আরে এসে বসো দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসতে বসতে সুখ দুঃখের কথা শোনায়, কোন নেতার বাড়ি পর্যন্ত রাস্তাটা খুব ভালো করে তৈরি হয়েছে তার ফিরিস্তি দিয়ে বলে, তা হ্যাঁ দাদা তোমাকে যারা পাঠিয়েছে তাদের গিয়ে বলো না, একটু আমরা কেমন আছি তা এসে দেখে যেতে।
সামনে বাচ্চাগুলো পুকুরে নেমে হুটোপুটি লাগিয়েছে মহানন্দে। বলে, এখন সিপিএমের কেউ বেশি কথা বলছে না, বলছে যা হবে সামনের বৎসর কেরোসিনের আলোয়। সেলাই মেসিনে হাল্কা প্যাডেল মারতে থাকে, কারেন্ট থাকলে মোটরে চলত। বলে, বুঝলে দাদা, আমরা রুইব, আমরা খুইব, আমরা বুনব আর শহরের বাবুরা সব কিনবে। এই মশারি নিয়ে গেলুম তো আমাকে পিস পিছু ৫০ টাকা ধরিয়ে দিল, আবার কবে মাল নিতে আসব তা জানিয়ে দেবে বলে ভাগিয়ে দিল। অথচ ওখানে ওরা ১০০ জন আর এখানে আমরা ১০০০ জন, কিন্তু আমাদের কথা কি ভাবে? এদিকে আমাকে ডাকতে এসেছেন আরেকজন, যাঁর বাড়ি যাওয়ার কথা আগে থেকে হয়ে আছে। আমি উঠে দাঁড়াই। ছেলেটি বলে, এই যে আপনি এখন এর সাথে বসে কথা বলবেন, এর কিন্তু তাতে ফায়দা নেই, ও যদি এখন রাস্তায় ভ্যান চালায় তাহলেও তো দুটো পয়সা হয়। আবার রাগ করবেন না যেন।
পিছনে একটি বাচ্চা কাকে দেখে যেন চেঁচাচ্ছে — ‘জামাইবাবু, কমলালেবু’।
পার্থ কয়াল, ফলতা, ১৩ এপ্রিল
Leave a Reply