১৫ মে, অমিতা নন্দী#
আমাদের গ্রুপে উপস্থিত ৩৫-৪০ জনের মধ্যে আমাদের মতো চার-পাঁচজন ছাড়া আর সবাই চাষি, বেশিরভাগই ছোটো চাষি, মহিলা চাষি ছিলেন ১০-১২ জন। আমাদের গ্রুপের কো-অর্ডিনেটর অনুপম পাল জানালেন, আজকের আলোচনার শেষে দ্বিতীয়ার্ধে উপস্থিত হবেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কৃষিমন্ত্রী। তাঁর কাছে আলোচনার নির্যাস উপস্থাপিত করা হবে। জৈবচাষে সরকারের পক্ষ থেকে যাতে উৎসাহ দেওয়া হয় সেই দাবিও মন্ত্রীকে করা হবে। গ্রুপের পক্ষ থেকে সে দায়িত্ব নিলেন মেদিনীপুরের একজন মহিলা চাষি এবং তাঁকে সাহায্য করবেন পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি থেকে আসা কাজলা জনকল্যাণ সমিতির কো-অর্ডিনেটর শ্রী দেবাশিস পণ্ডা।
আলোচনায় যেসব বিষয় ও প্রশ্ন উঠে এসেছিল, যতটা বুঝতে পেরেছি, তা এরকম :
১। চাষের উপকরণ
চাষের উপকরণ বলতে বোঝায় বীজ, সার, কীটনাশক, সেচ ইত্যাদি। এখনকার যে মূল ধারার চাষ অর্থাৎ অজৈব বা ইনঅর্গানিক চাষ, সেখানে চাষিকে রাসায়নিক সার, বীজ, কীটনাশক ইত্যাদি কিনে জমিতে প্রয়োগ করতে বাধ্য করা হয় বেশি বেশি উৎপাদনের লোভ দেখিয়ে। গত ১০ বছরে রাসায়নিক সারের দাম এমনকী তিনগুণ বেড়েছে, বীজের দামও বেড়েছে ব্যাপকভাবে। কিন্তু কৃষিজ পণ্যের দাম এবং মজুরের দাম সেই অনুপাতে বাড়েনি। এইসব (বাহ্যিক) উপকরণ না কিনে কি চাষ করা সম্ভব?
২। উৎপাদন ব্যয়
উৎপাদন ব্যয় কমাবার জন্য কোনো সরকারি সাহায্যের ব্যবস্থা আছে কি? থাকলে কীভাবে তা পাওয়া যায়?
৩। বীজ ও তার বৈচিত্র্য
ভারতে মোট ৮২,০০০ রকম ধানের বীজ, ৩৬৬৮ রকম বেগুন, ৩৮,০০০ রকম গম, ১৪,০০০ রকম ছোলা, ১৬,০০০ রকম অড়হর, ৪০০০-এরও বেশি রকম নটের বীজ ইত্যাদি ছিল। দেশীয় গরু ছিল ৬১ রকম প্রজাতির। তাহলে কেন আজকে চাষিদের এই অবস্থা? আমাদের গোয়ালভরা গরু, পুকুরভরা মাছ, খেতভরা ফসল — কোথায় গেল? কোথায় গেল আমাদের চাষিদের পরম্পরাগত জ্ঞান?
৪। উৎপাদনশীলতা
পশ্চিমবঙ্গে উচ্চফলনশীল বীজের চাষে যেখানে হেক্টর প্রতি ৩ টন ধান উৎপাদন করা যায়, সেখানে জৈবচাষে উৎপাদিত হয় হেক্টর প্রতি ৬ টন। দেশীয় ধান কবিরাজ শাল-এর ১০০ গ্রাম চালে ১৮ মিলিগ্রাম আয়রন এবং ৪৬ মিলিগ্রাম আয়রন ও ২০ মিলিগ্রাম জিংক পাওয়া যায়। আমাদের বহুরূপী, কেরালা সুন্দরী, মেঘনা ডম্বরু ইত্যাদি দেশীয় প্রজাতির ধানের এক একটা শিষের ওজন কখনো কখনো ৯ গ্রাম পর্যন্ত হয়, যা কোনো আধুনিক প্রজাতির ধানে কখনো হয় না। তাহলে সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন করা যায়, কেন আমাদের স্কুলের শিশুদের মিড-ডে মিলে স্বাস্থ্যকর চাল খাওয়াব না?
উত্তর ২৪ পরগনার সুন্দরবনের যোগেনগঞ্জ থেকে আসা চাষি পারুল মণ্ডল বললেন, আমার ১২ কাঠা জমিতে ২ কাঠি ধান বুনেছি, কোনো উপকরণ ছাড়াই। ৭ বস্তা ধান হয়েছে (১ বস্তা = ৬০ কেজি)। লাল কেরালা সুন্দরী। খেতে দেড় থেকে দুই ফুট জল রেখেছি। বর্ষার চাষ (আমন)। ধান গাছের উচ্চতা ছিল ৫ ফুট। দুবার করে গাছের ডগা (শিষ ধরার আগে) কেটে গরুকে খাইয়েছি। আর বস্তা প্রতি ১১০০ টাকা দরে সেই ধান বিক্রি করেছি।
৫। বাজারের বীজ
এবার প্রশ্ন ওঠে, বাজার থেকে বীজ না কিনে ধান চাষ করতে পারি কি না? সমস্বরে উত্তর আসে, হ্যাঁ, বিনিময়ের মাধ্যমে আমরা দেশি ধানের বীজ সংগ্রহ করতে পারি।
৬। রাসায়নিক সার ছাড়া চাষ
এই প্রশ্নে কেউ কেউ বললেন, রাসায়নিক সার ছাড়া চাষ সম্ভব, যদি জমিতে যথেষ্ট কেঁচো থাকে। কেঁচো আসবে কোথা থেকে? কোনো কোনো সংস্থা নাকি কেঁচো বিক্রি করে। জৈবচাষের সহায়তাকারী একজন অবাঙালি বয়স্ক মানুষ রামকানাই গুপ্তা বললেন, গোবর-গোমূত্র-চিটে গুড় দিয়ে মিশ্রণ তৈরি করে জলের সাথে বিশেষ মাত্রায় মিশিয়ে প্রয়োগ করলে জমিতে আপনা থেকে কেঁচো আসবে। তিনি অল্প কিছু ছাপানো কাগজ-পুস্তিকা (মূলত হিন্দি) এনেছিলেন। আমরা সংগ্রহ করতে পারিনি। তিনি সবাইকে মনে করালেন যে, ‘কেঁচো চাষির বন্ধু’ এই কথাটি ১১৫ বছর আগে বলেছিলেন চার্লস ডারউইন। অথচ আমরা আধুনিক চাষে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক নির্বিচারে প্রয়োগ করে এই বন্ধুদের সংহার করছি।
৭। সেচ
আর একটি জরুরি প্রশ্ন হল, সেচ লাগবে কি না? জবাব এল, বর্ষায় লাগবে না। কিন্তু অন্যসময় সীমিত সেচ লাগে। ভূপৃষ্ঠের জল আর ভূগর্ভের জল ব্যবহার করায় তফাত আছে। আমরা ভূগর্ভের জল যথাসম্ভব কম ব্যবহার করতে চাই। তাই জোর দেওয়া উচিত পুকুর কাটা এবং বৃষ্টির জল সংরক্ষণের ব্যবস্থায়। জমিতে আগাছা যাতে না জন্মায় এবং জমির আর্দ্রতা বজায় থাকে সেজন্য গাছের শিকড় বা ঝোপঝাড়ের পাদদেশে খড়, পচাপাতা ইত্যাদির আস্তরণ করলে জল কম লাগে।
৮। আগাছা
কৃষিবিজ্ঞানে আগাছা বলে কোনো কথা নেই। মোনোকালচার অর্থাৎ একক বা একফসলি চাষের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আগাছা কথাটা আসে। যা কিছু সমস্যা তাকে সম্ভাবনায় পরিণত করাই জৈবচাষের দৃষ্টিভঙ্গি। সেদিক থেকেই আসে মিশ্রচাষের কথা। এখন (গ্রীষ্মকালে) মুগ, লাল আলু বোনার সময়, কারণ এগুলি খরা সহনশীল। মরসুম অনুযায়ী ফসলের পরিকল্পনা করা দরকার। যেমন, বেগুনের সঙ্গে গাঁদা, তুলসি; পেঁয়াজের সঙ্গে উচ্ছে (পোকার ক্ষতি এড়াতে) ইত্যাদি। মিশ্রচাষ আমাদের পরম্পরাগত শিক্ষা — আমরা তা ভুলে গেলাম কেন? আমেরিকার শিক্ষায়?
বাংলাদেশে জৈবচাষের অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন তরুণ চাষি তনভির আহমেদ। তিনি যশোরের কাছে ঝিনাইদহ জেলা থেকে এসেছেন, ‘উন্নয়নধারা’ নামক সংগঠনের পক্ষ থেকে। বললেন, বাড়ির আশপাশের আবর্জনা, কাঁচা গোবর (বা ইউরিয়া জল ছিটিয়ে) আমরা ভার্মি কমপোস্ট সারের গাদা তৈরি করি। … ওখানে ৬৮০০ কৃষক পরিবার এই চাষ করে কিছু জমিতে, আর কিছু জমিতে তারা আধুনিক চাষ করে …
কীটনাশক সম্পর্কে জানা গেল, মেহগিনির ফল গুঁড়ো করে জলে ভিজিয়ে জমিতে কাদা করার সময় বিঘা প্রতি ৬ কেজি করে মেশালে মাজরা পোকার উপদ্রব থেকে বাঁচা যায়। নিম, করঞ্জার ফল থেকে তেল বের করার পরে যে খোসা বা খোল থাকে তা থেকেও কীটনাশক তৈরি করা যায়।
৯। গো-মূত্রের ব্যবহার
গোমূত্র এবং জল ১:৬ অনুপাতে মিশ্রণ প্রয়োজন বীজশোধনের জন্য। কিন্তু খেতে তা প্রয়োগ করলে পাতা পুড়ে যায়। ১:১০ অনুপাতের মিশ্রণ পাতায় স্প্রে করা যায়। অবশ্য গোমূত্র মাটিতে পড়ার আগেই ডাইরেক্ট কাঁচের বোতলে ধরে এয়ারটাইট অবস্থায় ২০ দিন ছায়ায় রেখে দিতে হয়, তারপর তাতে জল মেশাতে হয়।
রামকানাই গুপ্তা বললেন, সবসময় গ্রামে এবং খেতের কাছে বড়ো ফলের গাছ (বৃক্ষ) লাগান, তবেই জল আসবে। মনে রাখবেন, প্রকৃতি আমাদের জন্য জল দেয় না, বড়ো বৃক্ষের জন্য জল দেয়।
১০। প্রযুক্তি
সবশেষে আসে প্রযুক্তির কথা। প্রযুক্তির বিভিন্ন ব্যবহার হল : ১। দেশজ বীজের ব্যবহার, ২। সেচ ব্যবস্থা, ৩। বেড, সার্কুলার বেড, ডাবল ড্রেগিং বেড, ৪। মাল্টিস্টোরিড চাষ — জমির অপটিমাম ইউটাইলেজশন (সর্বাপেক্ষা অনুকূল ব্যবহার)-এর জন্য (উদাহরণ, সবচেয়ে নিচে মাটিতে কচু, হলুদ প্রভৃতি গাছ লাগানো যাদের বেশি ছায়া লাগে, তার ওপরে লাউ-শসা-কুমড়োর মাচা, তার ওপরে উচ্ছের মতো হালকা সবজির মাচা যাদের বেশি রোদ লাগে। একে বলে তিনতলা মাচা চাষ।), ৫। বস্তায় বা টবে চাষ, ৬। আপৎকালীন চাষ (যেটা বন্যার সময়েও করা যায়)।
হলঘরের প্রথমার্ধের আলোচনাসভা শেষ হতে প্রায় একটা-দেড়টা বেজে গেল। মধ্যাহ্নভোজের বিরতি — সবাইকে শুভেচ্ছে জানিয়ে আমরা নিচে নেমে এলাম। ফেরার সময় কিছু কিছু চাল, মুড়ি, মুড়কি, চিঁড়ে, অল্প সবজি ইত্যাদি কিনলাম। বর্ধমান জেলার কালনা থেকে একটি সংস্থার কর্মীরা বসেছিলেন সুগন্ধি কালো চাল, কবিরাজি শাল ইত্যাদি নিয়ে। বর্ধমান জেলায় যেখানে আধুনিক চাষের রমরমা সেখানেও জৈবচাষ শুরু হয়েছে জেনে ভালো লাগল। যার যার ঠিকানা জোগাড় করা সম্ভব হল নিয়ে আমরা ফেরার পথ ধরলাম।
Leave a Reply