সুকুমার হোড় রায়, কলকাতা, ১৩ সেপ্টেম্বর#
দুপুরবেলা, মধ্যাহ্ন পার হতে চলেছে। বামুনপাড়া বাজারের দোকান সব বন্ধ হয়ে আসছে। মাছওয়ালা-সবজিওয়ালারা দু-একজন এখন-ও বসে আছে। বিক্রিয় আশাতে। বাজারমুখী খদ্দেরদের আসা অনেকক্ষণ আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। রাস্তায় মানুষের আনাগোনা, চলাচল কমে আসছে। একটু পরেই ফাঁকা হয়ে যাবে, সেই সময়ে দু-একজন মানুষকে যাতায়াত করতে দেখা যাবে। হেলেদুলে চাকার ক্যাঁচর-ক্যাঁচর শব্দে বয়েল গাড়ি নিয়ে, মিছরিলাল বামুনপাড়া বাজারের উত্তরদিকের রাস্তা ধরে বেলেঘাটার কয়লা ডিপোয় নিজের ডেরায় পৌঁছাবার পথেই যেতে যেতে হাতটা কানে নিয়ে, বাঁ হাতের তালু দিয়ে বাম কানটা আলতোভাবে ঢেকে বেসুরো গলায় গান গাইতে শুরু করে দিল। কোনও তাড়া নেই চাবুক মেরে বয়েল হাঁকিয়ে ডেরায় ফেরার, হেলতে দুলতে গাড়ির চাকা ক্যাঁচর ক্যাঁচর শব্দ করে এগোচ্ছে। বড়ো করুন, মর্মভেদী মুলকী দেহাতী গান। যেন বুকের গভীর থেকে দুঃখ বেদনা ঝরে পড়ছে। যা চাপা থাকে সারাদিন কাজ আর ব্যস্ততায়।
রাত হলে, বেশি রাতে, যখন মানুষের বাড়ির বাইরে বার হওয়া, রাস্তায় যতায়াত, চলাচল কমে আসে। ফাঁকা রাস্তা ঠেলা ঠেলে ঠেলে নিয়ে নিজেদের আস্তানায় ফেরার পথে কানহাইয়ালাল, রামগুলাম-রা ঠেলা ঠেলতে ঠেলতে খুশিতে, আনন্দে গাইতে শুরু করল চৈতি, ফাগুয়া, বা কাজরী, পুরবী। বা রাস্তা, ফুটপাথে খাটিয়া পেতে, একদিকে উনুনে তরকারি চাপিয়ে, আটা মেখে ছেনে রুটি তৈরির ব্যবস্থা করছে, আরেকদিকে ঢোল নিয়ে খাটিয়াতে গোল হয়ে বসে পূরবী, কাজরী, বিরহা গাইতে শুরু করেছে। রাস্তায় যেতে-আসতে, আশেপাশের বাস বা দাঁড়িয়ে থাকা কেউ ওদের এই ভোজপুরীতে গাওয়া গান শুনে মুচকি হেসে, একটু চেঁচিয়ে বলল, বাহহো, বহুত বড়িয়া গানা, বা, জিও মেরে ইয়ার।
শ্রাবনের বিদায়ে, ভরা ভাদরে, প্রথম সপ্তাহ পার করে, ২৫ আগস্ট মধ্যরাতে, লালা লাজপত রায় সরণি, যা এলগিন রোড নামে পরিচিত, সেখানে বৈতানিকের ফাঁকা ঘাসহীন জমিতে পাতা বিছানো চেয়ারে বসে আছি। বৈতানিকের দু-তলা বাড়িটার প্রবেশ পথে, বারান্দায় শতরঞ্চি, চাদর বিছিয়ে ঢোল, তবলা, বাঁশির সাথে, নেপাল সীমান্তে অবস্থিত বিহারের সাহারসা জেলা থেকে আগত দলিত-মহাদলিত পরিবারের লোকগীতি শিল্পী সন্তোষ তুফানী, বীরেন্দার কুমার, কামাক্ষা প্রসাদ, ইন্দরজিৎ যাদবদের গাওয়া বিহারের লোকগীতি পূরবী, কাজরী, ফাগুয়া, চৈতি শুনতে শুনতে স্মৃতির সরণি বেয়ে পৌঁছে গেলাম সেই দিনগুলিতে। ভাবে বিহ্বল হয়ে স্মৃতির অতলে ডুব দিলাম। দলিত-মহাদলিত পরিবারের এই লোকগীতি শিল্পীদের হাওয়া গান শুনতে শুনতে মনে হল, বড়ো ভালো ছিলাম শৈশব-কৈশোরে, বড়ো ভালো ছিলাম বন্ধু-বান্ধব, সঙ্গীসাথি, পাড়া-প্রতিবেশীদের সাথে। মিলেমিশে, সুখে-দুঃখে, আপদে-বিপদে, দু-চোখে স্বপ্ন ছিল বড়ো হবার, মানুষের মত মানুষ হবার।
পৃথিবীতে কবিতার জন্ম যদি দুঃখ থেকে হয় যদি, তাহলে সঙ্গীতের জন্ম হয়েছে শ্রম থেকে। মাঠে, ক্ষেতে কাজ করতে করতে, পরিশ্রমের কষ্ট লাঘব করতে, কাজে উৎসাহ বাড়াতেই সৃষ্টি হয়েছিল সঙ্গীতের। ঋতুভিত্তিক কৃষিকাজ, গ্রামীন জীবনকে কেন্দ্র করে গ্রামীন মানুষের জীবনের সুখ, দুঃখ, ব্যাথা, বেদনা, চাওয়া-পাওয়া, আনন্দ, প্রেম, বিরহ মিলন নিয়ে লেখা ও সুরারোপিত এই লোকগীত শুনতে শুনতে এই উপলদ্ধি হলো। জীবনের অনুভূতি যেন হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে উৎসারিত হয়ে, গানের কথায় পরিণত হয়েছে, যে গানের কথা ও সুরে আছে মাটির গন্ধ ও ফসলের ঘ্রাণ। আছে দুঃখ, বেদনা পার্থিব বঞ্চনার হাহাকার। এই আরাম, ভোগ, বিলাস, সুখের জীবন জমি বাড়ি, ধন সম্পত্তি, বাবা, ভাই, বোন, স্ত্রী, পুত্র-কন্যা সব ছেড়ে চলে যেতে হবে একদিন। থেকে যাবে শুধু দেহের খাঁচায় বন্দী আছে যে আত্মা। অন্য কোনও শরীরে প্রবেশ করার জন্য। সহজিয়া জীবন ও দেহতত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে লেখা কবীরের ওদের লোকগীতের আসর শুরু, যে নির্গুণ ভজন শুনলেই মনে হবে, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত রাগ, খেয়াল, ধ্রুপদ-ধামার সৃষ্টি হয়েছে এই লোকসঙ্গীত থেকে। পরে যা মার্জিত হয়ে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত রূপে স্থান পেয়েছে রাজা, মহারাজা, নবাব-বাদশাহ-দের দরবারে। ভোজপুরীতে গাওয়া কবীরের এই নির্গুণ ভজনগুলি। কবীর নিজেও যে ভোজপুরী ভাষী ছিলেন।
কড়ি জ্বালকর কয়লা ভয়ো, কয়লা জ্বালকর রাখ (ছাই) ভয়ো। কঙ্কর (পাথর) চুন চুন কর, মহল বানায়া, লোগ কহে ইয়ে মহল মেরা, ইয়ে মহল না মেরা, না তেরা, চিড়িয়া রহেন কা বসরা (বাসা)।
তারপর রাধা কৃষ্ণের প্রেম বিরহ মিলন নিয়ে গাথা কাজরী, পূরবী, হোলি নিয়ে ফাগুয়া, চৈতি ইত্যাদি গেয়ে শোনান সন্তোষ তুফানি, কামাক্ষা প্রসাদ, বীরেন্দার কুমার, ইন্দরজিৎ যাদবরা। ইন্দরজিৎ যাদবই এদের মধ্যে জাতে একটু উঁচু আহির (গোয়ালা) সম্প্রদায়ের। বাদবাকি সকলে মহাদলিত বা অতিশূদ্র। বয়সে সকলে তরুণ। পঁচিশ থেকে তিরিশের মধ্যে। বড়োদের সাথে কোনও আখড়ায়, কারও বাড়ির দাওয়ায়, উঠোনে বসে বা উন্মুক্ত আকাশের নিচে মাদুর শতরঞ্চি বিছিয়ে এদের গান শেখা, গানের চর্চা শুরু। সেখান থেকে গ্রামীন মণ্ডলীতে, গ্রামে-গঞ্জে গান গেয়ে শোনাতে শোনাতে এখন এরা নিজেদের জেলার বাইরে অন্য রাজ্যতে গান শোনাতে যায়। এখন বিহারে ভোজপুরী ভাষী এইরকম দশ হাজার লোকসঙ্গীত শিল্পী তৈরি হয়েছে। বিহার সরকার ও বাংলা নাটক ডট কমের মতো সংস্থার উদ্যোগে ও প্রচেষ্টায়। এদের মধ্যে মহিলা শিল্পী গাইয়েরা আছে। যদিও মহিলারা পুরুষদের সাথে একসাথে কোনও মঞ্চে বা আসরে বসে গান গায় না। এই গান গেয়ে শোনানো এখন তাদের পেশা হয়েছে। অর্থ উপার্জনের উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভোজপুরী ছাড়া এরা মৈথিলীতে ভিখারী ঠাকুরের লেখা কিছু পূরবী-কাজরী গেয়ে শোনান, যা রাধাকৃষ্ণের মাধুর্য্য রস, প্রেম বিরহ মিলন নিয়ে লেখা লোকগীত।
দশজনের এই দলে দু-একজন বাদে সকল গায়ক — বাদক-ও। গাইতেও জানে, খোল করতাল ঢোল তবলা বাঁশি হারমোনিয়াম ইত্যাদি বাজাতেও জানে।
Leave a Reply