প্রীতমবন্ধু মজুমদার, জলপাইগুড়ি, ১২ জানুয়ারি#
জলপাইগুড়ি জেলার সদর শহর জলপাইগুড়ি। এনজিপি স্টেশন থেকে দূরত্ব ৪০-৪৫ কিমি। এনজিপি স্টেশন থেকে শহরে ঢোকা বেশ কষ্টসাধ্য। উত্তরবঙ্গের বিভাগীয় প্রধান শহর। কিছুটা নামেই। প্রধানত আমার দেখা শান্ত শহর এটা। প্রতিদিনই সকাল আটটা নাগাদ ধীরে ধীরে শহর জাগে। ব্যস্ত হয়। বিকেলের পরেই মোটামুটি কর্মব্যস্ততা অনেকটা কমে আসে। তারপরে লোকজন সন্ধ্যেবেলায় বিভিন্ন ঠেকে আড্ডায় ভাগ হয়ে যায়। ন-টা বাজতে বাজতে যে যার বাড়ি। এবং শহর ঘুমিয়ে পড়ে। এই শান্ত চেহারা নিয়েই বেশ কয়েক বছর ধরে এই শহর চলছিল নিজের গতিতে। হঠাৎ কিছু বোমাতঙ্কের কথা শোনা গেলেও সেই অর্থে খুব বড়ো ধরনের কিছু ঘটেনি বেশ কিছু বছর ধরে।
২৬ ডিসেম্বর কেএলও-র (কামতাপুর লিবারেশন অর্গানাইজেশনের) শহিদ দিবসে সেই চিত্রটা পুরোপুরি পাল্টে গেল। শহর সংলগ্ন পাহারপুরের কাছে বজরা পাড়াতে এক শক্তিশালী বিস্ফোরণে মোট ছয়জনের মৃত্যু হয়। এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। বিস্ফোরকটি নাকি একটি সাইকেলে রাখা ছিল। জলপাইগুড়ি শহর থেকে পাহারপুর যেতে একটি ছোটো ব্রিজ আছে। সেইখানে বেশ কিছু স্থানীয় ছেলে প্রতিদিনই আড্ডা মারে। সেদিন সন্ধ্যাতেও তারা আড্ডা দিচ্ছিল। প্রচুর কুয়াশা ছিল। তারাই নাকি ওই সাইকেলে রাখা ব্যাগটি দেখতে পায়। তাদের মধ্যেই একজন ব্যাগটির ভেতরে কিছু খাবার আছে সন্দেহ করে ব্যাগের ভেতরের কৌটোটি খুলতে যায়। এবং তৎক্ষণাৎ বিস্ফোরণ হয়। সাইকেলটি ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। নিহতদের দেহের বিভিন্ন অংশ ঘটনাস্থলে ছড়িয়েছিটিয়ে পড়ে এবং তিনজন ঘটনাস্থলেই মারা যায়। এবং পরে হাসপাতালে আরও দু-জন মারা যায়। কদিন পরে আহতদের মধ্যে থেকে আরও একজন মারা যায়।
সেই সময় জলপাইগুড়িতে বইমেলার আর দু-তিনদিন বাকি ছিল। আমি বইমেলাতে ছিলাম। আমার কাছে বিভিন্ন জায়গা থেকে ফোন আসতে থাকে, তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আয়, জলপাইগুড়িতে বড়োসড়ো বিস্ফোরণ হয়েছে। আমি তখন বইয়ের স্টলে বই দেখছিলাম। রাতারাতি পরিবেশটা পালটে গেল। তবে বইমেলাতে এর খুব বেশি প্রভাব পড়ল না। আমি তৎক্ষণাৎ বাড়ির দিকে রওয়ানা দিই। এবং রাস্তায় আসতে আসতে বুঝতে পারি যে শহরে কিছু একটা হয়েছে।
সেদিন থেকে শহরের সাধারণ চিত্রটা পুরোপুরি পালটে গেছে। প্রচুর পুলিশ সিআরপিএফ নেমে যায় শহরে, পরের দিন থেকে। বিভিন্ন রাস্তায় তারা টহল দিতে থাকে। এবং বাড়ির থেকেও যে কোনো জায়গায় যাওয়া নিয়ে একটা নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। কোনো জায়গায় খুব বেশিজন একসঙ্গে থাকলে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তার একদিন পরেই সন্ধ্যেয় আবার একটি ব্যাগ পাওয়া যায় চার নম্বর গুমটির কাছে। তখনও আমি বইমেলাতে ছিলাম। সেই সময় আবার আমার কাছে বিভিন্ন জায়গা থেকে ফোন, তাড়াতাড়ি বাড়ি আয়। তৃতীয় দিন, যেদিন বইমেলা শেষ হল, সেদিন বইমেলার চেহারা একদমই আলাদা। পুরো বইমেলা চত্বর পুলিশ সিআরপিএফ দিয়ে ঘেরা। ব্যারিকেড করে করে, বইমেলায় যারাই ঢুকছে, তাদেরকেই চেকিং চলছে। শুনেছিলাম, খবর ছিল, বইমেলাতে বিস্ফোরণ হতে পারে। এখনও টহলটা চলছে। আমার কিছু বন্ধু আড্ডা দিচ্ছিল, তাদের মারধোরও করেছে সিআরপিএফ। প্রথমে বোমের ভয়, তারপর সিআরপিএফের ভয়।
প্রশাসন বলল, এই বিস্ফোরণ নাকি কেএলও-রাই ঘটিয়েছে। লোকাল নিউজে জানা গেল, বেশ কয়েকজন কেএলও জঙ্গীকেও নাকি ধরা হয়েছে। উত্তরবঙ্গের জঙ্গী সমস্যা দীর্ঘদিনের। বিভিন্ন সময় তা ঘুরে ফিরে এসেছে। এর আগেও ছোটো খাটো বিস্ফোরণ হয়েছে, একটা হয়েছে আলিপুর দুয়ারে। একটা বিস্ফোরণ হয়েছে ট্রেনের মধ্যে। তবে সেগুলি সবই শহরের বাইরে হয়েছে। একদম শহরের মধ্যে এই প্রথম। উত্তরবঙ্গের ছয় জেলার যে লোকজন, তারা যেন পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় শ্রেণীর লোকজন — এই ভাবনা উত্তরবঙ্গের মানুষের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করে। পশ্চিমবঙ্গের প্রথম জরুরি দিক হলো কলকাতার যে লাগোয়া জেলাগুলো, সেখানকার মানুষজনের সমস্যা। আর উত্তরবঙ্গে জেলার মানুষজনের সমস্যা দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। বিভিন্ন লোকের সঙ্গে এতদিন কথা বলে বুঝেছি, এই বঞ্চনার ইতিহাস দীর্ঘদিনের। এবং এই বঞ্চনা নিয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভও দীর্ঘদিনের। এই বঞ্চনা আমরা বন্ধ চা বাগানেও বহুদিন দেখেছি। এখানকার সামগ্রিক উন্নয়নের দিক থেকেই এটা দেখা যায়। রাস্তাঘাটের অবস্থা তো বলার নয়। শিলিগুড়ি থেকে জলপাইগুড়ি রাস্তার যা হাল, তা বলার নয়। কাউকে বলেও কোনো লাভ হয় না। মানি মার্কেট প্রচুর বেকার ছেলেদের কর্মসংস্থানের আশা দেখিয়ে এখন তাদের টাকা নিয়ে কেটে পড়েছে। সেখানেও কারও কিছু করার নেই, কাউকে কিছু বলার নেই। সমস্যা আরও অনেক আছে, এখানে যারা থাকে তারা প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে সেগুলোর মুখোমুখি হচ্ছে। কিন্তু সন্ত্রাসের আবহে তার উৎসের খোঁজ করবে কে?
Leave a Reply