বঙ্কিম, ২২ মার্চ#
সাইকেল র্যালি, এই চৈত্রে চরা পড়া চরাচরের বিল বাওড় পুকুর ডোবা জলাশয় বাঁচাতে। আসলে সবকিছুকে বাঁচিয়ে বেঁচে থাকার জন্যই ভোর ভোর বেরিয়ে পড়া। মিনিট পনেরো হেঁটে গিয়ে বাস ধরলাম। এই যে ঘন্টাখানেক তেল পুড়িয়ে পৌঁছলাম নৈহাটি, তারপর বৈদ্যুতিক ট্রেনে কাঁচরাপড়া স্টেশন — এও খটকা লাগে। তবু যদি পুরোটাই সাইকেলে যেতে পারতাম! ঘটনাক্রমে সেই ট্রেনেই উল্টোডাঙা থেকে সাইকেল সমাজের লোকেরা হাজির। বেহালা থেকে আসছে সুরজিত, সাথে শান্তনু। ওরা তো হুড়োহুড়ি করে কাঁচরাপড়া গেট স্টেশনেই নেমে পড়েছে। আবার সব ট্রেন তো ওই স্টেশনে থামে না। তাই ওরা ছুটতে ছুটতে কাঁচরাপড়া স্টেশনে এল। এরপর সবাই মিলে স্টেশনের সাইকেল গ্যারেজের দীপদা-দের সহযোগিতায় বেশ কতগুলো সাইকেল নিয়ে শুরু হল আমাদের সাইকেল যাত্রা। স্টেশন লাগোয়া ত্রিকোণ পার্কে পোস্টার ব্যানার সুসজ্জিত হয়ে একচোট রকমারি ক্যামেরার শট পেছনে ফেলে আমাদের যাত্রা হল শুরু।
সকালের মিষ্টি হাওয়ায় রোদে মাখামাখি হয়ে আমাদের সাইকেল চলছে মথুরা বিলের পথে। কলকাতা থেকে প্রীতম, শুভায়ন, কোন্নগর থেকে কৌশিক — এরা নজরকাড়া বিশেষ সাইকেল নিয়ে আমাদের সাথি হয়েছে। একটু চলতে না চলতেই দুটি কিশোর ছেলে সাইকেল নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে আমাদের সাথে। জানতে চাইল, আমরা কোথায় যাব। আমরা মথুরা বিল বাঁচাতে চাই। জলাশয় পাখি রক্ষার কথা বলছি। শুনল আগ্রহভরে। চলল আমাদের সাথেই। লাটাই ছিল ওদের হাতে, ঘুড়ির টানে খানিক বাদে ওরা চলে গেল — আজ ওদের ছুটির দিন, রবিবার। এদিকে শহরের পথে যেতে যেতে বিজ্ঞান দরবারের মাইক-ই-দরবার তীব্র হচ্ছে। চ্ছ্রবিজ্ঞানমনস্ক’ মানুষের কাছে এগিয়ে আসার, সচেতন হওয়ার, এক হওয়ার, প্রতিবাদ করার, জলাভূমি প্রকৃতি রক্ষা করার আহ্বান। রোদ চড়ছে। ছোট্ট একটা লিফলেট দিয়ে নাগরিকদের কাছে জলাশয় ও প্রকৃতি রক্ষার দরবার করছেন জয়দেব দে, তাপস মজুমদার, সমীর, সৌরভ, সুকল্যাণ, কিঞ্জল-রা। চলতে চলতে খানিক থেমে শান্ত স্বরে শমীক বলে, এইসব জলাশয়-বিলগুলোই আমাদের নগর জীবনের ফুসফুসের মতো। আমাদের নির্মল রাখছে। করছে সতেজ। অথচ কিছু ক্ষমতাশালী শক্তি, প্রোমোটার এসব ধ্বংস করছে, যারা ক্ষমতার বলে এমনকী একটা জেলার সব রাজনৈতিক দলগুলোকেও কিনে নিতে পারে। একমাত্র মানুষের এ বিষয়ে সচেতনতা, এগিয়ে আসার মাধ্যমেই আমরা বিপন্ন জলাশয়ের রক্ষা করার চেষ্টা করতে পারি। এরপর আমরা কল্যাণী রোডে সাইকেল নিয়ে পিল পিল করে চলছি; ডানদিক দিয়ে গাঁক গাঁক করে মোটরগাড়ি তীব্র হর্ন দিয়ে আমাদের সজাগ করে চলে যাচ্ছে। ওপাশে রাস্তার ডানধারে বিস্তৃত মথুরা বিল। এই প্রখর শুখায় বিলে চাষ হচ্ছে, কোথাও যেন জলের চিহ্ন মাত্র নেই। এক বিস্তৃত প্রান্তর। অথচ, ভরা বর্ষায় কানায় কানায় যখন এই বিল ভরে ওঠে, তখন কী অপরূপ শোভা!
এরপর নগরের পথে খানিক ঘুরে ঘুরে এসে থামল র্যালি বাজারের মাঝে, শুরু হল সাইকেল সমাজের রঘু জানার রোদে পোড়া তপ্ত ভাষণ, দোকানদারদের কাছে আবেদন, প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ বর্জন করুন। বললেন, উল্টোডাঙায় কেষ্টপুর খাল সংস্কারের সময় আশেপাশের মানুষ দেখেছিল, কীভাবে এই বিপুল প্লাস্টিকের আবর্জনা খালকে গ্রাস করে ফেলেছিল। এবং সেখানে ব্যবসায়ীরাই সচেতন হয়ে প্লাস্টিকের মালপত্র দেওয়া বন্ধ করে দেয়। মায়ের ছায়ায় দাঁড়িয়ে বাজারের মাঝে ছোট্ট ফুটফুটে মেয়েটি অবাক চোখে চায় — সাইকেল সহ বুকে পিঠে পোস্টার সাঁটা মানুষের দিকে। বোধহয় দেখছে, জলাশয় পাখিদের ছবি, হয়তো বা পড়ে ফেলে চ্ছ্রবাস্তুতুতন্ত্র’ রক্ষার পোস্টারটাও।
আবার চলতে চলতে এবার চলেছি কুলিয়াপাঠের বিলের দিকে। জলাভূমিকে ঘিরে ধরেছে পাঁচিল, পাঁচিলের আড়ালে জমে আবর্জনার স্তুপ। রাতারাতি ভরতে থাকে জলাশয়। কচুরিপানা জড়ো হতেও লাগে না সময়। জলাভূমিকে ঘিরে ফেলা হয়েছে খুঁটি ও তার দিয়ে। পশুপাখি মানুষ প্রকৃতি থেকে আলাদা করে রাখা কচুরিপানায় বদ্ধ জলাশয়। এখানেই আমরা সকলে সাইকেল নিয়ে বিলের ধারে দাঁড়িয়ে বেশ পোজ দিয়ে ছবি তুললাম। মোটরবাইকে যেতে যেতে বাইকার বলল, এভাবে কিছু হবে না। ইনি বড়ো ব্যস্ত মানুষ। জিজ্ঞাসা করেও জানা গেল না, কীভাবে হবে জলাভূমির রক্ষা। অথচ গরু চরাচ্ছিলেন যে মানুষটা, তিনি ক্ষোভের সাথে বললেন, দেখুন কচুরিপানা পরিষ্কার করার লক্ষ লক্ষ টাকা চুরি হয়। অথচ বিলের অবস্থা দেখুন। কচুরিপানা যে কে সেই আছে। অনুপ বলছিলেন, আবর্জনা ফেলার ডাস্টবিন নয় বিল। সরাসরি নগরের আবর্জনা বিলের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে দেখো কীভাবে। বিলের ধারে দাঁড়িয়ে গভীর আবেগের সাথে অনুপ বলে বিলের ইতিহাস। তার গবেষণা, পাখপাখালি। বিপন্ন জলাশয়ের প্রতি মমত্বের কথা। আর সম্রাটের ক্যামেরায় এই আকালেও ধরা পড়ল নাছোড়বান্দা পাখি।
বেদীভবন হয়ে সাইকেল র্যালি এবড়োখেবড়ো পাথর বিছানো পথে চলল বয়সা বিল। এখানে বিল গ্রাস করেছে কোম্পানিরাও। বিত্তবানদের বাগিচা হয়েছে, চলছে ফুলের চাষ। এই টানের দিনে পাম্প বসিয়ে যথেচ্ছ ভূ-গর্ভের জল তুলে বোরোধানের চাষ চলছে। অথচ এই দিকটাই ভূ-গর্ভস্থ জল আর্সেনিকে বিষাক্ত।
ক্ষমতা মদমত্ততার বিপরীতে আমাদের জলাভূমি প্রকৃতি রক্ষার সাইকেল যাত্রা হঠাৎই রুদ্ধ হল সাহেববাগানের সামনে। বড়ো বড়ো সব গাছ কেটে ফেলছে ওরা, এইসব উঁচু-উঁচু গাছ লালন করেছিল এই গ্রামেরই মানুষ। দিনের পর দিন। বছরের পর বছর। আজ সেসব গাছ স্মৃতিভারে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে ভেঙে পড়ছে চোখের সামনে। প্রতিবাদে কিছু কণ্ঠ আর্তনাদ করল।
এতক্ষণে একটা ছোট্ট পুকুর পারে আমগাছের তলায় এসে বসলাম। এই ভরদুপুরে একজন হাতড়ে হাতড়ে ধরছে ছোট্ট ছোট্ট মাছ কাঁকড়া। গল্প হচ্ছে তারই সাথে, বছরভর এই পুকুরে জল থাকে। এই ছোট্ট জলাশয়ের ছায়ায় মায়ায় ক্লান্তিতে জড়িয়ে আসে সারা শরীর। কাছেই এক প্রবাসীর বাড়ির গাছতলায় শরবত পানে প্রাণ জুড়োল। এরপর কথায় কথায় সবার কাছে শমিত বলল, চূর্ণী নদীর কথা। কারখানার আবর্জনা, পৌরসভার নোংরা সরাসরি এসে নদীর জলকে বিষিয়ে তুলছে, নদীকে গ্রাস করছে। আমাদের চূর্ণীর পার ধরে একটা সাইকেল র্যালি করার প্রস্তাব রাখল।
স্বাগতা ও সাগরকাকার ব্যবস্থাপনায় খিচুড়ি বেগুনি চাটনি খাওয়া আর বহুদূরে ট্রেনের চলাচল দেখতে বারবার ফিরে আসতে চাইবে মন।
তবুও সাইকেল যথাস্থানে ফেরত দিয়ে ফিরে যাওয়ার তাড়ায় সুরজিত ইন্দ্রজিত ধীমানরা ছুটল ঊর্ধশ্বাসে। ভরপেট গরম খিচুড়ি আর মাথার ওপরে দারুণ অগ্নিবাণে সাইকেল চালাতে চালাতে কী ভাবা যায় — এই পথে পথে পাথর ছড়ানো? অথচ এই পথেই সকলকে পিছে ফেলে ভীষণ জোরে ছুটে যাচ্ছে রঘুদার সাইকেল। ভেসে আসছে গান — একূল ওকূল দুকূল ভেসে যায়!
কিছুটা এগিয়ে এই চলার পথ খুব মসৃণ হতেই একটা ট্রাক একটা কুকুরকে পিষে চলে গেল। চোখ বন্ধ হয়ে গেল। খানিকটা গিয়ে সাইকেল থেমে গেল। অনুপ ছুটে গিয়ে বোতল উজাড় করে সমস্ত জল পরম মমতায় ঢেলে দিল ওইরকম রক্তাক্ত মুমূর্ষু প্রাণে।
Leave a Reply