সংবাদমন্থন প্রতিবেদন, ১৩ সেপ্টেম্বর#
সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি যৌনহেনস্থার ঘটনা ঘটে। ঘটনা এবং তার পরম্পরা নিম্নরূপ :
মেয়েটির বয়ানে ঘটনা
২৮ আগস্ট কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়য়ে ছেলেদের হোস্টেল সংলগ্ন ওপেন এয়ার থিয়েটারে কলাবিভাগের সংস্কৃতি (ফেস্ট) চলছিল। ফেস্ট চলে বেশ রাত অবধি, এবং অনেক ছাত্রছাত্রী এমনকি তাদের বাইরের কলেজের বন্ধুরাও সেখানে উপস্থিত থাকে। সন্ধ্যেবেলা একটা বিশেষ সময়ের পরে সমস্ত বিভাগ বন্ধ হয়ে যায়, স্বাভাবিক ভাবেই কোন বাথরুমও খোলা থাকে না, বিশেষত মেয়েদের বাথরুম। এইরকম সময় প্রয়োজন পড়লে ‘ওপেন এয়ার থিয়েটার’ নামক মঞ্চের পেছনে গাছপালার আড়ালে গিয়েই কাজ সারতে হয়। এই দিনটাতেও ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রী তার বন্ধুকে (ছেলে) নিয়ে বিশেষ প্রয়োজনে বের হয়। ফিরবার পথে কয়েকটি ছেলে তাদের উদ্দেশ্যে আপত্তিজনক মন্তব্য ছুঁড়ে দেয়। প্রতিবাদ করায় এই ছেলের দল আরও ক্ষেপে ওঠে এবং বাকবিতণ্ডার পাশাপাশি ধাক্কাধাক্কিও শুরু হয়ে যায়। মেয়েটি তার বন্ধুদের ফোন করতে গেলে তার ফোন কেড়ে নেওয়া হয় এবং বন্ধু ছেলেটিকে এরপর মারধর করা হয়। হেনস্থাকারী ছেলেগুলি এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই হোস্টেল-নিবাসী ছাত্র এবং বেশিরভাগই ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের। এতেও শেষ হয় না, মেয়েটিকে হোস্টেলে নিয়ে গিয়ে প্রচুর জিজ্ঞাসাবাদ ও হেনস্থা করা হয়। হস্টেলের সুপার এই ঘটনার সময় হাজির ছিলেন এবং তিনি এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী।
পরম্পরা
এই ঘটনার পরেরদিন, ২৯ আগস্ট মেয়েটি তার বাবাকে সঙ্গে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে। উপাচার্য বলেন যে তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন। তিনি পরবর্তী পনেরো দিন মেয়েটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে নিষেধ করেন। আন্টি র্যাগিং কমিটি বা সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট সেল এমনকি আভ্যন্তরীন অভিযোগ দায়ের করার কেন্দ্র আইসিসি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে সে কথা তিনি জানানোর প্রয়োজন বোধ করেননি অভিযোগকারিনীকে। পুলিশি সহায়তার কথাও এড়িয়ে যান।
১ সেপ্টেম্বর মেয়েটি থানায় এফ আই আর করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েটির বন্ধুবান্ধবসহ কলাবিভাগের বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী ৩ সেপ্টেম্বর স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠনের দাবীতে ছাত্রদের ডিনকে ডেপুটেশন দেবে ঠিক করে। এই কমিটিতে মনোবিশেষজ্ঞ, অবসরপ্রাপ্ত আইন জীবি, মানবাধিকার কর্মীদের রাখার কথা জানায় তারা। তারা আরো বলে যে ৭ দিনের মধ্যে তদন্ত শুরু করতে হবে এবং কীভাবে বিষয়টি এগোচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের বিশদে জানাতে হবে।
কিন্তু এরমধ্যে উপাচার্য মেয়েটির বাবার সঙ্গে কথা বলে ঘোষণা করে দেয়, বিশ্ববিদ্যালয় নিজে ঘটনার তদন্ত করবে। এফআইআর হওয়া সত্ত্বেও এবং সেই এফআইআর-এ অন্তত একজন হেনস্থাকারী ছাত্রের নাম থাকা সত্ত্বেও পুলিশ নিষ্ক্রিয় থাকে, কর্তৃপক্ষও অভিযুক্ত ছাত্রদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেই চুপচাপ বসে থাকে। অবস্থা দাঁড়ায়, যৌনহেনস্থার অভিযোগকারিনী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ‘পরামর্শ’মতো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পনেরো দিনের জন্য ‘সাসপেন্ড’, যৌনহেনস্থায় অভিযুক্ত ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় এবং হস্টেলে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি তুলে সংগ্রাম মুলতুবি রাখে ছাত্র ইউনিয়নগুলো।
কিন্তু অভিযোগকারিনীর বন্ধুরা দমেনি। যৌনহেনস্থার অভিযোগ সত্ত্বেও কোনো গ্রেপ্তারি না হওয়ায় ৫ সেপ্টেম্বর যাদবপুর থানায় মিছিল করে যায় ছাত্রছাত্রীরা। পুলিশ বলে, সত্তর শতাংশ চিহ্নিতকরণের কাজ হয়ে গেছে, তাদের আরো খানিক সময় লাগবে। যদিও ছাত্রছাত্রীদের কারোর কারোর বক্তব্য, হস্টেল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আনাচে কানাচে নিয়ম করে প্রতিদিন দু-বেলা খোঁজখবর নেওয়ার জন্য হানা দেয় অন্তত একাধিক থানার এবং ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের ‘ইনফর্মার’রা — আজ বছরের পর বছর ধরে। উপাচার্য বলেছেন, পুলিশকে পূর্ণ স্বাধিনতা দেওয়া হয়েছে তদন্ত করার। অথচ আজ, ১৩ সেপ্টেম্বর অবধি কোনো অভিযুক্ত গ্রেপ্তার হয়নি। একজন অভিযুক্তকে চেনা গেছে, তাও তাকে গ্রেপ্তার করা বা বয়ান নেওয়া হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়য়ের আভ্যন্তরীন অভিযোগ জানানোর সংস্থা আইসিসি (ইউজিসি কর্তৃক নির্ধারিত) এই ধরণের বিষয় নিয়ে তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছিল। এই সংস্থার তরফ থেকে দুজন ভারপ্রাপ্ত মহিলা, বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষিকা, উওমেনস স্টাডিসের ঐশিকা চক্রবর্তী ও সংস্কৃত বিভাগের সর্বাণী গাঙ্গুলি জিজ্ঞাসাবাদ করার উদ্দেশ্যে মেয়েটির বাড়িতে যান ৫ তারিখেই। যাওয়ার আগে মেয়েটিকে জানানো হয়নি। সেখানে তাঁরা মেয়েটিকে উক্ত ঘটনার দিন তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদ কী ছিল, সে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ছিল কিনা প্রভৃতি প্রশ্ন করেন। এতে মেয়েটি মানসিকভাবে আরও বিপর্যস্ত বোধ করতে থাকে । নারী নির্যাতনের বিষয়ে স্বীকৃত বিশাখা গাইডলাইন মোতাবেক, অভিযোগকারিনীকে প্রশ্ন করার সময় এই ধরণের অস্বস্তিকর প্রশ্ন করা যায় না। মেয়েটি বিধাননগর পুলিশ স্টেশনে একটি জেনেরাল ডাইরি করে এই বিষয়ে।
প্রসঙ্গত, এই ধরণের প্রশ্ন — নিগ্রহের পেছনে পরোক্ষে নিগৃহীত বা নিগৃহীতার হাত কতখানি ছিল, তা কেবলমাত্র যৌন-হয়রানির ক্ষেত্রেই ওঠে। এতে নিগ্রহের গৌণ কারণগুলি ( যথা নিগৃহীতার অসাবধানতা) কে বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলা হয়। বিশেষত তা নিগ্রহের গুরুতর অপরাধটিকে হাল্কা করে দেয়। তদন্ত কমিটির সদস্যদের মুখ থেকে এই ধরণের প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই অপ্রত্যাশিত বলে মনে হয় নিগৃহিতার বন্ধু ছাত্রছাত্রীদের। তারা তাই প্রতিবাদ জানান। প্রতিবাদে গীতশ্রী সরকার নামক ছাত্রপ্রতিনিধি এই কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন। ৮ সেপটেম্বর উপাচার্যের কাছে যায় ছাত্রেরা, ডেপুটেশন দেয় এবং আইসিসি-র সদস্যদের এই ধরণের অমানবিক আচরণের কারণ জানতে চায়। উপাচার্যের হয়ে ডেপুটেশন নেন সহ-উপাচার্য, কিন্তু তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। সেদিন ছাত্রছাত্রীদের মূল দাবিগুলি ছিল – ১। যারা অত্যাচারিতা মেয়েটিকে এই অমানবিক প্রশ্ন করেছেন তাঁদের কমিটি থেকে বাদ দিতে হবে। ২। তদন্ত পদ্ধতি এবং তদন্ত কমিটির সদস্যদের নাম জানাতে হবে। ৩। কবে তদন্তের ফল পাওয়া যাবে তা ঘোষণা করতে হবে ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ থাকে অরবিন্দ ভবনে (উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, রেজিস্ট্রার, এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল মিটিং রুম প্রভৃতি)। তার বাইরের গাড়িবারান্দায় ছাত্রেরা অবস্থানে ছিলেন, ভেতরে আইসিসি-র মিটিং চলছিল। ছাত্ররা ঠিক করেন যে আইসিসি যতক্ষণ না কোন সদুত্তর দিচ্ছে, ততক্ষণ সদস্যদের বেরতে দেওয়া হবে না। সদস্যেরা বেরোতে গেলে ধাক্কাধাক্কি হয়। পরেরদিন অন্তত একটি বড়ো মিডিয়ায় ‘শিক্ষিকা নিগ্রহের’ অভিযোগ ওঠে ছাত্রদের বিরুদ্ধে। তৃণমূলের ছাত্রনেতারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থেকে এর প্রতিবাদে অনশনের হুমকি দেয় মিডিয়ার কাছে।
অবশেষে তিনজন ছাত্র প্রতিনিধি আইসিসি-র সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পায়। আইসিসি অপ্রীতিকর প্রশ্ন করেছে বলে স্বীকার করে না এবং ছাত্রছাত্রীদের বলে মিডিয়ার কাছে এইসব ‘অহেতুক উত্তেজক’ কথাবার্তা না বলতে।
ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে তাদের প্রশ্নের উত্তর জানতে চায়। উপাচার্য মুখ খোলেননি। তিনি বলেছেন ইউজিসি নির্দিষ্ট আইসিসি-র বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়য়ের কর্তৃপক্ষ হস্তক্ষেপ করতে পারে না। এছাড়া এসবের পেছনে ছাত্রছাত্রীদের ইনডিসিপ্লিন বা উচ্ছৃঙ্খলতাকে দায়ি করছেন তিনি। যৌনহেনস্থার মত গুরুতর সামাজিক অপরাধকে উচ্ছৃঙ্খলতা হিসেবে সাধারণীকরণ দেখে ভীত ছাত্রছাত্রীদের ধারণা, এই অজুহাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে সিসিটিভি সহ অন্যান্য যান্ত্রিক নজরদারি বাড়াতে চাইবে কর্তৃপক্ষ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক কমিটি, এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের মিটিংয়ের মাধ্যমে স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠনের দাবীতে অনির্দিষ্টকালের জন্য ছাত্রছাত্রীদের দিবারাত্র অবস্থান চলছে ১০ সেপ্টেম্বর থেকে, অরবিন্দ ভবনের গাড়িবারান্দায়।
Leave a Reply