ভজন সেন, কলকাতা, ১৩ জুলাই#
বিশ্বকাপ ফুটবলকে কাছ থেকে দেখলে দুটো জিনিস খুব নজরে আসে। প্রথম : কুড়ি বছর আগে থেকেই খেলার সৌন্দর্য নষ্ট হতে বসা। খেয়াল করে দেখবেন খেলার কুশলতা প্রদর্শনের সুযোগ মারাদোনার সঙ্গে সঙ্গেই অস্ত গেছে। ব্রাজিল ইত্যাদি দক্ষিণ আমেরিকা ঘরানা সহ নানা ঘরানার শিল্প প্রদর্শনীও উঠে গেছে একই সময় থেকে। এখন সব ছক বাঁধা খেলা। ব্রাজিল তার আক্রমণাত্মক খেলা ছেড়ে ইতালির মতো রক্ষণাত্মক। কারণ, জিততে হবে। সকলকেই জিততে হবে। জয়ের জন্য যা উপযোগী, তাই গ্রহণীয়। তাই সব দেশের খেলার ছকই প্রায় একরকম। এ যেন আদিদাসের কারখানায় তৈরি সারি সারি একই রকমের বুটজুতো।
এখন কম্পিউটার প্রভৃতি আধুনিক প্রযুক্তির সুযোগ নিয়ে সবসময় সব খেলোয়াড়ের সবলতা-দুর্বলতার খুঁটিনাটি তথ্য বিশ্লেষণ করে আগে থেকেই বিপক্ষ দলের কোচেরা সকল প্রকার ওষধির ব্যবস্থা নিয়ে আধমরা খেলার চিকিৎসা করতে বসে। সাইড লাইনের ধারে কোচ ও কোচেদের সহকারীদের কাগজ-কলম নিয়ে নোট গ্রহণ করা, উত্তেজিত নির্দেশ পাঠানো ও তড়পানি আজ খেলার মতোই সমানভাবে দর্শনীয়। এত বেশি পরিকল্পনার মাঝখানে মেসির মতো দক্ষ খেলোয়াড়দের সৃষ্টির অবকাশ কমে গেছে। মুহূর্তের ভগ্নাংশের জন্য কল্পনার ডানা মেলা দেখতে ঘন্টার পর ঘন্টা রাত জেগে টিভির সামনে বসে থাকতে কাঁহাতক ভালো লাগে।
দ্বিতীয় : ফুটবল দেশাত্মবোধ। বিশ্বকাপ ফুটবলকে কেন্দ্র করে দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তোলা সহজ হয়, কারণ খেলাগুলো হয় এক দেশ বনাম আরেক দেশ। কিন্তু নতুন সহস্রাব্দে ফুটবল-দেশাত্মবোধ ম্রিয়মান। আর একটা কারণ দেশের ভেতরকার আর্থিক সংকট। মনে করে দেখবেন, এইবারে ব্রাজিলে বিশ্বকাপ বিরোধী যে বিক্ষোভ চলছে তেমনই গতবার দক্ষিণ আফ্রিকাতেও সাধারণ মানুষ বিক্ষোভ দেখিয়েছিল। এরকম সব দেশেই আছে — গত ইউরোকাপ জয়ী স্পেনের ফুটবলাররা বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘আমরা জানি আমাদের দেশের মানুষরা কী অবস্থায় আছে’। যারা অভাব অনটন কাটাতে পারছে না, তাদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ কি ফুটবল বিশ্বকাপ জাগিয়ে তুলত পারে? তাছাড়া বিশ্বায়ন যখন শুরু হয়ে গেছে, যখন দেশের সীমানা ফিকে হয়ে গেছে, ইউরোপের ক্লাবে ক্লাবে কোটি কোটি টাকায় বেচা কেনা হচ্ছে খেলোয়াড়দের, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির মতো ক্লাবগুলো বহুমূল্যবান খেলোয়াড়দের শেষ ক্ষমতাটুকু নিঃশেষ করে নিতে চাইছে টাকার বিনিময়ে, তখন দেশের জন্য জাতীয় ফুটবলের জন্য কতটাই বা আর দেওয়ার মতো বাকি থাকে বড়ো ফুটবলারের যতই সে মনে মনে দেশকে ভালোবাসুক। ক্লাব ফুটবল নিয়ে মাতামাতিও তো দুনিয়াজুড়ে কম হয় না। এরপরে বিশ্বকাপ ফুটবলের বদলে বিশ্বক্লাব কাপ ফুটবল, ফুটবলে উৎকর্ষের শ্রেষ্ঠ স্থান হয়ে উঠতে পারে।
Leave a Reply