সম্রাট সরকার, মদনপুর, ৩০ জানুয়ারি#
১)
বয়সা বিলে মাঝেমধ্যেই আমাদের পাড়ার কয়েকজন উঠতি বয়সের ছেলে বাঁধা মাচায় বসে থাকে, গল্পগুজব করে। ঘটনা হল, ভোরবেলায় মাছ ধরতে আসত যে জেলেরা, তাদের কেউ কেউ মাছের সাথে সরালও ধরত। তো ওই ছেলেরা একদিন এক জেলের জাল ছিঁড়ে দিয়েছে, জালে সরাল দেখতে পেয়ে। ধরা পড়া সরালও ছেড়ে দিয়েছে। ওরা আমাকে বলছে, টিনের একটা প্ল্যাকার্ড করতে হবে, তাতে লেখা থাকবে, এখানে পাখি মারা, ধরা প্রভৃতি নিষেধ।
নন্দীডাঙা থেকে বন্দুক নিয়ে শামুকখোল মারতে আসত প্রতিবছর কিছু লোক। তারা নাকি বলেছে, তোমাদের প্ল্যাকার্ড টাঙানো দরকার, যে এখানে পাখি মারা বারণ। তাহলে আর আমরা বক মারতে আসব না। ছেলেগুলোর প্রস্তাবটা মনে ধরেছে।
২)
কুলিয়াপাটের বিলে (কল্যাণীর লাগোয়া গয়েশপুর মিউনিসিপ্যালিটি, গান্ধি হাসপাতালের পেছন দিকে) রেকর্ড সংখ্যক পরিযায়ী পাখি এসেছে এই শীতে। নর্দার্ন শোভলার (খুবই দুর্লভ পাখি), স্মল প্র্যাকিং কোল এসেছে। নাকটা এসেছে। সরালও আছে — স্থানীয় পরিযায়ী পাাখি। গয়েশপুর ফিশারির পেছনের দিকে অবস্থিত এই বিলে ফিশারি একটা প্রকল্প হাতে নিয়েছিল, ‘ফ্রেশ ওয়াটার অ্যাকোয়া’ নাম দিয়ে। বোর্ড, টেন্ডার হয়ে গেছে। কাজটা হল — বিলের চারপাশটায় দু-মিটার কংক্রিট পিলার তুলেছে। জাল দিয়ে ঘিরবে। তাতে ফিশারির দাবি, ঠাকুর বিসর্জন, বাইরে থেকে জাল ফেলা — এসব বন্ধ হবে। তারা সেখানে মাছ চাষ করবে। বিলের সমস্ত শাপলা টাপলা তুলে ফেলে দিয়ে ড্রেজিং করে দেবে। তারপর নতুন জল দেবে।
আমরা কাঁচরাপাড়া বিজ্ঞান দরবার থেকে একটা ছোটো অনুষ্ঠান করেছিলাম, এর বিরুদ্ধে। কারণ, জাল-এ পাখি ধরা পড়বে। ড্রেজিং করলে স্থানীয় প্রাকৃতিক চক্র বিনষ্ট হবে। পরিযায়ী পাখি আসা বন্ধ হয়ে যাবে। তবে আমাদের থেকেও অনেক বেশি এই বিল বাঁচানোর জন্য আন্দোলন করেছে অনুপ হালদার। সে-ই ওখানে সবথেকে বেশি সক্রিয়ভাবে প্রতিবাদ করেছিল। জল টেস্ট করিয়েছিল কলকাতা থেকে বিজ্ঞানীদের নিয়ে গিয়ে, দেখিয়েছিল, এই জল সম্পূর্ণ দূষিত হয়ে যায়নি, এক্ষুণি জল পরিবর্তনের দরকার নেই। বোধহয় ডিএফও-কে চিঠি করেছিল।
তবে বিল যে একদমই দূষিত হয়নি, তা নয়। তিনরকম ভাবে কুলিয়াপাটের বিল দূষিত হচ্ছে। এক, গয়েশপুর মিউনিসিপ্যালিটির পুরো বর্জ্য পড়ছে, যদিও একটি বর্জ্য পরিশোধনের প্ল্যান্ট আছে, কিন্তু তা অকেজো। দুই, যত কারখানা বিলের ধার ধরে, সবার জল কালো করে দিয়েছে বিলের ধারগুলো। তিন, গান্ধী হাসপাতালের বর্জ্য। তাছাড়া বিলের ভেতরে পিকনিক, পাখি মেরে রোস্ট করে খাওয়া, গান বাজনা মাইক — এসবও চলছে।
এখন আমরা দেখছি জাল ঘেরা ও ড্রেজিং বন্ধ। অনেক পরিযায়ী পাখি ফিরে গেছে। আর মাসখানেক যদি এই স্থগিতাবস্থা থাকে, তাহলে পরিযায়ী পাখিগুলো বেঁচে ফিরতে পারবে। তারপর ওই ‘ফ্রেশ ওয়াটার অ্যাকোয়া’র পরিকল্পনা স্থায়ীভাবে বন্ধ করার বিষয়ে কী হবে না হবে, সে বিষয়ে ভাবতে হবে। আগে আপতকালীনভাবে পাখিগুলো যে বেঁচেছে, সেটাও বড়ো পাওনা।
ও হ্যাঁ, আর একটাও সুখবর আছে। বয়সা বিল-এর একধারে এক কোম্পানি বিলের একটি অংশ ঘিরে ইঁটের দেওয়াল তুলতে শুরু করেছিল বছর দেড়েক আগে। বেশ কয়েক মাস হয়ে গেল, কনস্ট্রাকশন বন্ধ আছে।
Leave a Reply