সংবাদমন্থন প্রতিবেদন, কোচবিহার, ৩১ জুলাই#
কোচবিহারে জানুয়ারি থেকে ৩১ জুলাই অবধি মোট ৪২ জন এনকেফালাইটিস আক্রান্ত রোগীর মধ্যে ২২ জন চিকিৎসায় সুস্থ হয়েছে, ২০ জন মারা গেছে। মৃতদের মধ্যে ৬ জন জাপানিজ বি এনকেফেলাইটিসে (সংক্ষেপে জেবিই) আক্রান্ত ছিল। বাকি ১৪ জনের অন্যান্য এনকেফেলাইটিস হয়েছিল — এমনই জানালেন কোচবিহারের এসিএমওএইচ ডা. এস প্রধান, ৩১ জুলাই একটি অনুষ্ঠানে।
প্রসঙ্গত জেবিই-র ভাইরাস আমাদের দেহে ঢোকায় কিউলেক্স বিষ্ণুই প্রজাতির মশা। ভাইরাসটি বক জাতীয় পাখি থেকে মশা হয়ে তারপর শূকর হয়ে ফের মশার দেহে যায়। মশার কামড়ে মানুষ আক্রান্ত হয়, তবে এর সংখ্যা খুবই কম। জেবিই-তে চিকিৎসার খুব কম সময় পাওয়া যায় — জানালেন প্রধান।
এনকেফেলাইটিসে মস্তিষ্কের আবরণ মেনিনজেস-এ ব্যাকটিরিয়া, ভাইরাস, প্রোটোজোয়ার আক্রমণে সেরিব্রো স্পাইনাল ফ্লুইড বেড়ে গিয়ে মাথা ব্যথা হয়। পনেরো বছরের কমবয়সি বাচ্চারা আক্রান্ত হয় বেশি। সিংহভাগ এনকেফেলাইটিস ছড়ায় দূষিত জল, খাবার এবং পরিবেশ থেকে। তিনশো থেকে হাজার জীবানুবাহকের মধ্যে একজনের সংক্রমণ হয়, রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা সাপেক্ষে। আধুনিক দূষণময় জীবন রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এই রোগের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। আক্রান্ত হলে মৃত্যুর সম্ভাবনা চল্লিশ-পঞ্চাশ শতাংশ। সেরে উঠলেও স্নায়বিক ক্ষতি হতে পারে। মানুষের থেকে মানুষের এই সংক্রমণ হয় না বললেই চলে।
মার্চ এপ্রিল মে মাসে বোরো চাষের জন্য ধান খেতে জল দাঁড় করিয়ে রাখতে হয়, যা থেকে মশার ব্যাপক বাড়বাড়ন্ত হয়। বৃষ্টিপাত কম হবার জন্য মজা ডোবা বা শহরের নালায় জল আটকে থাকে। সেখানেও মশার চাষ হয়। তাছাড়া অপরিকল্পিত নগরায়নে জল নিকাশি ব্যবস্থা পঙ্গু হয়ে যাওয়াও মশা বৃদ্ধির কারণ। আগামী বছর থেকে বোরো ধানের জমিতে যেন দু-দিনের বেশি জল জমে না থাকে, তা দেখা দরকার। তবে অক্টোবর মাসে এই রোগের প্রকোপ কমে যায়।
কিউলেক্স মশা অনেক দূর গিয়ে এনকেফেলাইটিস ছড়াতে পারে। রাসায়নিক ধোঁয়ার ব্যবহারে দেহের রোগপ্রতিরোধক ক্ষমতা কমে যায়। ফলে নিমপাতার ধোঁয়া, ধুনোর মাধ্যমে মশা তাড়ানো দরকার। বেশি দরকার পরিবেশ পরিষ্কার রাখা।
ডা. প্রধান জানালেন, এবারে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের স্লোগান ছিল — ‘ছোটো কামড়, বড়ো বিপদ’। এরই অঙ্গ হিসেবে এপ্রিল মাস থেকে উত্তরবঙ্গ জুড়ে স্বাস্থ্যদপ্তর মশাবাহিত রোগ বিষয়ে সচেতন হয়। ঠিক করা হয়েছিল, এনকেফেলাইটিসের সংক্রমণ বুঝলেই উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে পাঠানো হবে, কারণ জেলা/মহকুমা হাসপাতালে এর রক্ত পরীক্ষার কিট নেই। তাই এবছর এনকেফেলাইটিস রোগীরা উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে ভিড় করে। এই রোগে মৃত্যুহার বেশি তাই মেডিক্যাল কলেজে একসাথে এত রোগীর মৃত্যু হচ্ছে, যা মিডিয়ার নজরে পড়েছে। গত তিন চার বছর ধরে এই মৃত্যুগুলো গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা মহকুমা স্তরে হচ্ছিল এবং সেগুলোকে সেভাবে এনকেফেলাইটিস বলে শনাক্তও করা যাচ্ছিল না। এবারে দশ-কুড়ি শতাংশ সংক্রমণ বেড়েছে।
এনকেফেলাইটিস আক্রান্ত বাচ্চাদের শ্বাসনালীতে কফ প্রবেশ করে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। বাচ্চাদের চিত করে না শুইয়ে কাত করে শোয়ালে, গলা টান করে মাথা পিঠের দিকে টেনে ধরে রাখলে তা আটকানো সম্ভব। এতে শিশুমৃত্যু হার কমে।
ডা. প্রধান জানালেন, ৩ আগস্ট থেকে কোচবিহার এমজেএন হাসপাতালে এনকেফেলাইটিস শনাক্তকরণ কিট আসবে। অক্টোবর মাস থেকে পনেরো বছরের কমবয়সিদের জেবিই টীকা দেওয়া হবে। বড়োদের এই টীকার একটি পরীক্ষামূলক কর্মসূচি চলছে আসামে। তবে এত গরমে বাচ্চাদের জেবিই টীকা দেওয়া ঝুঁকির। টীকাতে দুর্বল ভাইরাস শরীরে ঢোকানো হয়, যাতে তা শরীরে ওই ভাইরাসের আগামী আক্রমণ প্রতিরোধে সক্ষম অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারে। কিন্তু এই গরমে ওই দুর্বল ভাইরাসটিও সবল হয়ে বাচ্চাদের শরীরে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। তাই একটু শীত পড়লেই টীকা নেওয়া সঙ্গত।
স্থানীয় মরশুমি ফল আম কাঁঠাল জাম বাতাবি লেবু স্বাভাবিক মরশুমি রোগ প্রতিরোধক। লেবু-জল ভাইরাসকে মূত্রের সঙ্গে বের করে দিতে সক্ষম।
Leave a Reply