মহিদুল মণ্ডল, কল্যাণগড়, ১৪ নভেম্বর#
মানুষটার সাথে বাজারেই আলাপ হয়েছিল। একদিন কথায় কথায় ওঁর বাড়ির কথা একটু বললেন — চলো আমার বাড়িটা দেখে আসবে চলো। কল্যাণগড় বাজারসংলগ্ন বাড়িটা দেখে চমকে গেলাম। একতলা ছোট্ট বাড়ির ছাদটা যেন একটা সবুজ কৃষিক্ষেত্র। ওই ছাদে কত কী চাষ করেছেন! ছাদের ওপর মাচার পরে বড়ো বড়ো পটল ঝুলছে, আর পটল গাছের গোড়াটা নিচে মাটিতে। এমন পটল বাজারে মেলে না। জমিতেও এত পটল ফলতে দেখিনি; যদিও ছেলেবেলা থেকেই মাঠে ঘাটে মানুষ হয়েছি, জন খেটেছি, চাষের কাজ করেছি। কিন্তু রতনদা জৈবসারই ব্যবহার করেন। নিজেই নিজের হাতে তৈরি করে নেন, হয়তো বা কখনো নামমাত্র রাসায়নিক সার দেন। ছাদে পটলের মাচার দেড় হাত ওপরে আছে আর একটা মাচা। সেখানে কুদরির চাষ হয়েছে। এছাড়া আছে বেগুন টমেটো লঙ্কা ঢ্যাঁড়শ, কাটোয়ার ডাঁটা, আরও কত কী। এত সব সবজি তিনি ফলান কিন্তু বিক্রি করেন না। নিজে খান আর বাদবাকি বন্ধু-স্বজনদের বিলিয়ে বেড়ান।
বিভিন্ন ঋতুতে চলে তাঁর বিভিন্ন রকমের চাষবাস। বাড়ি জুড়ে আছে রকমারি ফলের গাছ — নারকেল সুপারি আম গন্ধরাজ লেবু বাতাবি লেবু পাতিলেবু মুসুম্বি লেবু …। যত ফল-ফলাদি হয় বন্ধু-বান্ধব সকলে মিলেই খান। অবাক হয়ে চেয়ে দেখি তার ফুলের বাহার — রকমারি জবা টগর চম্পা আরও কত ফুল আমার নাম না জানা। বাড়িতে হাঁটাচলার জন্য এক চিলতে জায়গা ছেড়ে সারা বাড়ি জুড়েই গাছপালা — পুদিনা পাতার গাছ ব্রাহ্মী শাক স্ট্রবেরি তুঁতগাছ বনচাঁড়াল দারচিনি মিটমশলার গাছ। গোলমরিচ গাছে থোকাথোকা গোলমরিচ হয়ে আছে। ছাদের ওপরে নিচে গাছ লাগানোর জন্য বহু বিচিত্র ধরনের সিমেন্টের টব নিজের হাতেই বানিয়ে নেন। আগে ব্যবহার করতেন বিভিন্ন প্লাস্টিকের পাত্র। নিজের কাজ নিজেই করতে ভালোবাসেন। পঁয়ষট্টি বছর বয়সেও কঠোর পরিশ্রম করেন — হাতুড়ি ছেনি দিয়ে ছাদ খুঁড়ে খুঁড়ে নিজেই ছাদ মেরামত করেন।
এক সময় পাখি পুষতেন। তবে বরাবরই খরগোশ পোষেন। বড়ো বিচিত্র তাঁর লালন-পালন-সৃজন। বহু জাতের বিভিন্ন খরগোশের সংকরায়ন ঘটিয়ে বিচিত্র ধরনের খরগোশ সৃষ্টি করতেন। বিভিন্ন গবেষণাগারেও তাঁর খরগোশ যায়। খরগোশের জীবনপঞ্জি আদ্যোপান্ত তাঁর ডায়েরিতে লেখা আছে। কথায় কথায় বলছিলেন, একটা লোক নিয়মিত তাঁর খরগোশের জন্য ঘাস নিয়ে আসত। তাকে দেখে মনে হত সে খুব পশুপাখি ভালোবাসে। একদিন ভালোবেসে সেই লোকটিকে তার আদরের বদরি পাখিগুলো খাঁচাসহ দিয়ে দিয়েছিলেন। যে পাখিগুলো হাজার হাজার টাকা দিয়ে কিনতে এসেও কতলোক ফিরে গেছে। সেই পাখি তিনি দিয়ে দিয়েছিলেন ভালোবেসে। এরপর একদিন এক পাখির ক্রেতা এসে তাঁকে জানিয়েছিল, এত টাকা পেয়েও আপনি পাখিগুলো দিলেন না, অথচ আমি সামান্য টাকাতেই সেই পাখিগুলো সংগ্রহ করেছি। বড়ো ব্যথা পেয়েছিলেন রতনদা এই ঘটনায়। এমন করে পরিশ্রমী সৎ মানুষটিকে কেউ কেউ ঠকিয়েছে। তাঁর কাছ থেকে সুযোগসুবিধা নিয়ে জীবনে দাঁড়িয়ে গেছে। তবুও রতনদার বড়ো ইচ্ছা সত্যকার অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য কিছু একটা করার। তিনি কখনোই শ্রাদ্ধে নিমন্ত্রণ খেতে যান না।
অবসরপ্রাপ্ত সিআরপিএফ কর্মী রতনদা কখনো মর্নিং ওয়াক করে বডি ফিট রাখতেন না। তিনি মনের আনন্দে খেয়াল খুশিতে সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। তিনি সাইকেল চালাতে খুব ভালোবাসতেন। সাইকেলে দূরে দূরে চলে যেতেন। বনগাঁ (প্রায় পঁচিশ তিরিশ কিলোমিটার), জাগুলিয়া আরও কত জায়গায় সাইকেল নিয়ে চলে যেতেন। কাজেকর্মে। গাছগাছালি পাখপাখালি তাঁর বন্ধু। আর তাদের লালন পালন করেন, তাদের সঙ্গে কথা বলেন। হঠাৎই ২ নভেম্বর তিনি (রতন বসু) মারা গেলেন। একটা খরগোশ খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করল। মরে গেল! রতনদার কাছে আরও কত কী শেখার ছিল!
Leave a Reply