একজন অর্থনীতিবিদ এক দৈনিক সংবাদপত্রে লিখেছেন, ‘বিদেশভ্রমণে ভারতীয়রা গত বছর তেরো-চোদ্দো বিলিয়ন ডলার খরচ করেছেন। এই অঙ্কটা কমাতে পারলে এবং কিছু কিছু অদরকারি আমদানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করলে শেয়ার বাজার থেকে পালিয়ে যাওয়া ডলারের অনেকটাই পুষিয়ে যাবে’ তাঁর যুক্তি, ণ্ণডলারের জোগান কমছে’। তাই ‘টাকার নিরিখে ডলারের দাম বাড়ছে’। টাকার দাম পড়ে যাওয়াতে ‘এখন এক ডলারের পেট্রোল কিনতে গেলপঁয়তাল্লিশ টাকার বদলে পঞ্চান্ন টাকা দিতে হচ্ছে’। তাই আজ পেট্রোলের এতখানি মূল্যবৃদ্ধি। অতএব ডলারের জোগান বাড়াতে গেলে — এক, বিদেশভ্রমণে এত শত শত কোটি ডলার খরচ করা চলবে না; দুই, কিছু অদরকারি আমদানি কমাতে হবে।
কিন্তু বিদেশ থেকে অদরকারি আমদানি কী কী করা হয়? এর উত্তর সেই অর্থনীতিবিদ দেননি। সেগুলো আমাদের জানা দরকার। নাহলে আমরা পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধি রোধ করব কীভাবে?
আমাদের দেশ যারা চালায়, যারা বিভিন্ন দলের নেতা, তারা রুটিনমাফিক মিছিল-মিটিং-বনধ-পথ অবরোধে যত উৎসাহী, এইসব গোড়ার গলদ ধরে টানাটানিতে ততখানি উৎসাহী নয়।
আমরা সহজ বুদ্ধিতে জানি, যে জিনিস আমাদের অঞ্চলে পাওয়া যায় না, অন্য অঞ্চল থেকে আনতে হয়, তার জন্য বেশি হ্যাপা পোয়াতে হয়। অন্য দেশ থেকে আনতে হলে তো কথাই নেই, হ্যাপা অনেক। আমাদের দেশে যত পেট্রোল খরচ হয়, তার বেশিরভাগটাই বিদেশ থেকে আনতে হয়। আমাদের দেশে তেলের শোধনাগারের মোট ক্ষমতা দিনপ্রতি ৪২.৬ লক্ষ ব্যারেল। সেখানে শোধন করার জন্য যে তেল আনা হয়, তার মধ্যে এখন দিনপ্রতি ৩৫.৭ লক্ষ ব্যারেল আসে বিদেশ থেকে। মোট ত্রিশটা দেশ থেকে এই অশোধিত তেল আসে। এই পরিমাণটা বছর বছর বেড়েই চলেছে। অর্থাৎ আমাদের তেলের খিদে দিনে দিনে বাড়ছে।
আমরা সাধারণ মানুষ তো যাতায়াতের এত খরচ পোষাতে পারি না। পায়ে হেঁটে, সাইকেলে চেপে, বাসে এবং ট্রেনের মান্থলি কেটে যাতায়াত করি। আর টেলিভিশনে মিনিটে মিনিটে আমাদের মোটরগাড়ি চড়ার লোভ দেখানো হয়, খবরের কাগজে খবরের জায়গা দখল করে নেয় পাতাজোড়া মোটরগাড়ি আর মোটর সাইকেলের বিজ্ঞাপন! যদি তোমার পকেটে পয়সা নাও থাকে, লোন নিয়ে গাড়ি কিনে নাও! ফুর্তি করো!
এটাকেই বলে ফুটানি করা। বাংলায় আরও একটা চাঁছাছোলা কথা আছে, পরের ধনে পোদ্দারি করা! পেট্রোল তো পরেরই ধন, বিদেশ থেকে মোটা গুনাগার দিয়ে আনতে হয়। বাবুরা করবে ফুর্তি, আর সরকার তার ভর্তুকি মেটাবে। গত দশ-পনেরো বছরে মোটরগাড়ি কীভাবে বেড়েছে, তা আমরা সকলেই টের পাই। এর ওপর আছে মোটরগাড়ি আর মোটরবাইকের জন্য পরিবেশ দূষণ, রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম আর অহরহ দুর্ঘটনা।
অর্থনীতিবিদ বলেছেন, অদরকারি আমদানি কমানো দরকার। কোনটা আমাদের দরকারি আর কোনটা অদরকারি, সেটা কীভাবে ঠিক হবে? পেট্রোল বা তেলের ব্যবসায়ীরা তো চাইবেই তেলের চাহিদা আরও বাড়ুক। মোটরগাড়ি আর মোটরবাইকের কোম্পানিরা তো চাইবেই তাদের ব্যবসা বাড়ুক। যার হাতে অঢেল পয়সা আছে, সে তো নিজের আরামটুকু পেতে চাইবেই। কিন্তু সমাজ মানে তো একটা সমষ্টি। সেখানে দরকার-অদরকারের হিসেবনিকেশ কে করবে? জ্ঞানীগুণী পণ্ডিতেরা আবার অনেকেই এসব নিয়ে স্পষ্ট কথা বলতে ভয় পায়। কিন্তু আজ মূল্যবৃদ্ধির আগুনে যাদের গায়ে ফোস্কা পড়ছে, তারা কেন মাথা ঘামাবে না?
Leave a Reply