মহিদুল মণ্ডল, ভাতশালা, উত্তর চব্বিশ পরগনা#
গ্রাম থেকে কত কী যে হটে যাচ্ছে, উঠে যাচ্ছে, যাচ্ছে হারিয়ে। সেই ছেলেবেলা গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের ধারে একটা কামারশালা ছিল, সে বছর পঁচিশ আগের কথা, কবে যে উঠে গেল খেয়ালই করিনি। এখন আমার এই ভাতশালা গ্রামে কামারশালা নেই, আছে পাশের গ্রামে। সেখানে কামারের কাজটা তেমন যুতসই ঠেকে না। সেদিন হাত-দাখানা একটু ধার দেওয়ার দরকার হয়ে পড়ল। তাই ভাবলাম একটু দূরের গাঁয়ে গিয়ে দেখি সেখানে কাজের ধাতটা কেমন। ঝিকরার দিকে চললাম; সাইকেলে প্রায় মিনিট তিরিশেক হবে। গ্রামের এবড়ো খেবড়ো রাস্তা। বেলাশেষে ক্লান্ত দেহে ঝিকড়ার হাটে পৌঁছালাম। হাটের মাঝে ছোট্ট কামারশালা, বেড়ার ঘর, টালির ছাউনি। হাপড়-হাতুড়ি আগুন।
কামার সাধনের বয়স আমারই মতো বছর তিরিশ হবে। একটা দায়ে শান দিতে ষাট টাকা লাগবে বলতে একটু অবাক হয়ে বললাম, এটুকু কাজ করতে এত খরচ লাগবে। সাথে সাথে ও বলল, সবকিছুর বাজার দর বাড়ছে। কিন্তু আমাদের মজুরি বাড়ছে না। কী করে চলবে? কয়লার গুঁড়োর দামও বাড়ছে, সংসার চলবে কী করে? পাশে তার বন্ধু সিরাজ, সেও বোঝাতে চাইল, এইটুকু মজুরি তো দিতে হবে বলুন। বেশ খানিক কথাবার্তার পর ভাবলাম, এত পথ গিয়েছি যখন কাজ করিয়ে তবেই ফিরব। এরপর সাধন পঞ্চাশ টাকায় কাজ করিয়ে দিতে রাজি হয়ে বলল, কাল নেবেন। আমি জানালাম, অনেক দূর থেকে এসেছি, আর আমার এখনই দরকার। তখন ও বলল, একটু হাটে ঘুরে আসুন, সময় লাগবে। ওর কথায় মনে হল, ও যা হোক করে আমাকে কামারশালা থেকে সরাতে চাইছে। ও কিছুতেই যেন আমার সামনে কাজটা করবে না। আমিও খানিক নাছোড়বান্দা হয়ে বসে থাকলাম। ওর কাজের ধারা দেখব মতলব করে। একসময় কাজে হাত দিল, সিরাজের সাথে সাধনের কথা চলছিল। কথায় কথায় সিরাজকে বলল, একটা ঠান্ডা নিয়ে আয়। সিরাজ বলল, কী ঠান্ডা? সাধন জানালো, কিংফিশার নিয়ে আয়। আর কিছু কথাবার্তার পর একসময় সিরাজ সাধনের হাতে এক দেড়শো টাকা দিয়ে বলল, তুমি নিয়ে এস। আমি একটু কাজ সেরে আসছি। দেখলাম, আমার কাজ করতে সাধনের বড়োজোর মিনিট পনেরো লাগল, আমি ওকে পঞ্চাশ টাকা দিতেই ও একজনের কাছ থেকে কুড়ি টাকার লটারির টিকিট কিনল।
এরপর আমি বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম, সেদিন ভ্যানওয়ালা বলছিলেন, মদ না খেলে রাত জেগে ভ্যান চালাতেই পারব না। হাবড়া থেকে টিন নিয়ে ফিরছিলাম ভাতশালা গ্রামে, ভ্যানচালক জানালো একশো টাকার সাথে কিন্তু আরও দশ টাকা জলপানি দিতে হবে। আমি রাজি হয়ে ভাবছিলাম, জলপানি বোধহয় চা টিফিন হবে। পরে কথায় কথায় বলছিলেন, উনি একটু মদ খেয়েই এই ভাড়াটা নিয়ে এলেন, আবার ভাড়া খেটে গিয়েই আরও খানিক মদ খাবেন। উনি সকালের দিকে একটা স্কুলের ভাড়া খাটেন। আর একটু বেশি রাতের দিকে ট্রেনের প্যাসেঞ্জারদের ভাড়া খাটেন। এতে একটু বেশি ভাড়া পাওয়া আয়। বাড়িতে স্ত্রী ও দুটি ছেলেমেয়ে আছে। বলছিলেন, আসলে কি জানেন ভ্যানওয়ালারা মদ খায়। আর মদ না খেলে রাত জেগে ভ্যান চালাতেই পারব না।
Leave a Reply