সংবাদমন্থন পত্রিকার তরফে একটি খসড়া কালপঞ্জি তৈরি করা হয়েছে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও তৎসংক্রান্ত আন্দোলন নিয়ে। পাঠকদের কাছে আহ্বান রাখা হচ্ছে, তারা নিজেদের জ্ঞান মতো এই কালপঞ্জি নির্মাণের প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারেন। এর সঙ্গে কি কি যুক্ত করা প্রয়োজন তা যদি নিচের মতামত-এর জায়গায় লিখে দেন, তাহলে সেগুলি খসড়া পঞ্জিতে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়ে একটি সামগ্রিক কালপঞ্জি নির্মাণের দিকে এগোনো যেতে পারে #
২৮ ফেব্রুয়ারি
জামাত শিবিরের হরতালে বিক্ষিপ্ত হিংসা চলতে থাকে। বেলা এগারোটায় সাঈদির রায়দান শুরু হয় ট্রাইবুনাল-১ এ। সাঈদির ফাঁসির রায় ঘোষণা করে ট্রাইবুনাল-১। তার বিরুদ্ধে আনা ২০টি অভিযোগের মধ্যে ৮টি প্রমাণিত হয় এবং তার মধ্যে দুটিতে তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয়। রায় শুনে সাঈদি বলেন, শপথ এবং বিবেকের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে এই রায় দেওয়া হয়নি। শাহবাগ আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি কিছু বলতে গেলে তাকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে জামাতের সমর্থকেরা প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে পড়ে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। রংপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিরাজগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁ, চাপাইনবাবগঞ্জ, নোয়াখালি, মৌলভিবাজার, সাতক্ষীরা, গাইবান্ধা, কুমিল্লা, নাটোর, যশোর, লক্ষ্মীপুর, পাবনা এবং ঢাকায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়, হতাহত হয় বহু মানুষ। বেসরকারি মতে নিহত ৫৫ জন, আহত হাজার পাঁচেক। কয়েকটি জায়গায় সংখ্যালঘুদের উপাসনাস্থল এবং দোকানপাটের ওপরও চড়াও হয় বিক্ষুদ্ধরা।
২৭ ফেব্রুয়ারি
পরদিন জামাত-ই-ইসলামির প্রধান দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী-র যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায় ঘোষণা হওয়ার কথা। কাল সারাদিনরাত হরতালের ডাক দেয় জামাত শিবির। রাতেই ঢাকায় একটি বাস ও একটি পাবলিক হলারে আগুন লাগানো হয়। অপরদিকে হরতাল বিরোধী মিছিলের ডাক দেয় শাহবাগের আন্দোলনকারীরা। গণজাগরণ মঞ্চের একটি সমাবেশ হয় মতিঝিলে শাপলা চত্বরে। সেখানে সাঈদির ফাঁসির দাবি জানিয়ে বলা হয়, ট্রাইবুনাল যেন গণদাবির প্রতি সম্মান করে এবং জামাতের হিংসাতে ভয় না পায়। সেখানে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত শাহবাগ না ছাড়ার শপথ নেওয়া হয়। এসএসসি পরীক্ষা ৮ মার্চ অবদি পিছিয়ে দেওয়ার ঘোষণা করে সরকার। উল্লেখ্য সর্বপ্রথম এই সাঈদির বিরুদ্ধেই অভিযোগ জমা পড়ে ট্রাইবুনালে। এবং তার বিচারই সবার আগে শুরু হয়। কিন্তু তার বিচার প্রক্রিয়া অনেকদিন ধরে চলে। সাঈদির আগেই বাচ্চু রাজাকার ও কাদের মোল্লার রায় ঘোষণা হয়ে যায়।
আমার দেশ পত্রিকায় ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের শাহবাগ আন্দোলনকারীদের প্রশংসা করে বিবৃতির উল্লেখ করে একটি খবরে বলা হয়, শাহবাগ আন্দোলনের পাশে রয়েছে ভারত।
ণ্ণইমান ও দেশ রক্ষা আন্দোলন’ নামে একটি নতুন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক জোট আত্মপ্রকাশ করে। তারা প্রেসকে জানায়, তারা জামাতের আদর্শের বিরুদ্ধে। ণ্ণইসলামবিরোধী সব তৎপরতা বন্ধ এবং আল্লাহ-রাসুল ও কোরআন-সুন্নাহ বিষয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপকারীদের’ কঠোর শাস্তির দাবিতে আগামী শুক্রবার জুমার নামাজের পর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সামনে সমাবেশ করার ঘোষণা করে ধর্বভিত্তিক ন’টি দল ও আলেমদের জোট। লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ইমান ও ইসলামবিরোধী সব তৎপরতা বন্ধ এবং আল্লাহ-রাসুল ও কোরআন-সুন্নাহ বিষয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপকারীদের কঠোর শাস্তির দাবিতে সারা দেশে তৌহিদি জনতা আন্দোলন করছে। এই আন্দোলনে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন মারা গেছেন। অনেকেই গ্রেপ্তার এবং হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন। এ অবস্থায় বিক্ষিপ্ত এই আন্দোলনকে সুশৃঙ্খল রূপদানের লক্ষ্যে দেশের শীর্ষ উলামা-মাশায়েখ ও সঠিক ইসলামি আকিদায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল ও অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সমন্বয়ে ণ্ণইমান ও দেশ রক্ষা আন্দোলন’ গঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, খেলাফত মজলিস (ইসহাক), খেলাফত মজলিস (হাবিবুর রহমান), নেজামে ইসলাম বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ফরায়েজী আন্দোলন ও খেলাফতে ইসলামীর শীর্ষ নেতারা এবং ঢাকা ও আশপাশের ১১টি কওমি মাদ্রাসার আলেমরা এটায় রয়েছে।
২৬ ফেব্রুয়ারি
গণজাগরণ মঞ্চ প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায়, যদিও তারা একটি রাজনৈতিক দাবি নিয়ে লড়াই করছে, কিন্তু এটি একটি নির্দলীয় মঞ্চ এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দল নির্বিশেষে সবাই এখানে আছেন। এই মঞ্চে আছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের কিছু ব্লগার, অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট, বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। তারা আরও জানায়, তাদের দাবি : ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নয়, জামাত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। যদিও তাদের প্রাথমিক ছয় দফা দাবিতে ছিল, জামাত শিবির সহ ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। তবে এই প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ফের তারা বলে, ণ্ণধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার’। এবং আরও জানায়, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ নিয়ে গণজাগরণ মঞ্চের সুনির্দিষ্ট কোনও অবস্থান নেই। বিকেলে একটি প্রতিনিধিদল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে গিয়ে আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের দাবি জানায়। অভিযোগ, ধর্মের প্রতি অবমাননাকর বক্তব্য প্রচার, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও ধর্মীয় উন্মাদনায় উসকানি দেওয়া।
২৫ ফেব্রুয়ারি
মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরে গণজাগরণ মঞ্চের সুবিশাল শহীদ স্মরণ সমাবেশ হয়। উল্লেখ্য ণ্ণকাদের মোল্লা’ মিরপুরের কসাই নামে কুখ্যাত। নিহত ব্লগার রাজীবের জানাজা করেছিলেন যে ইমাম, তাকে হুমকী দিয়ে এক যুবক গ্রেফতার হন। মন্ত্রীসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দেন, সরকার কেবল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে। কোনো ধর্মীয় সংগঠন বা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার চিন্তাভাবনা সরকারের নেই। এমনকি জামাতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার ব্যাপারেও সরকার কিছু করবে না, এব্যাপারে একটি মামলা চলছে ২০০৯ সাল থেকে। আদালত কী সিদ্ধান্ত নেয়, তা দেখে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। এছাড়াও ধর্মভিত্তিক দলগুলিকে উসকানি দেওয়ার জন্য নয়া দিগন্ত, আমার দেশ প্রভৃতি কয়েকটি সংবাদমাধ্যম নিষিদ্ধ করার দাবির বিষয়ে তথ্যমন্ত্রী বলেন, প্রেস কাউন্সিল আইনে এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনও ব্যবস্থা নেই। এই দিন ব্রাহ্মণবেড়িয়াতে গণজাগরণ মঞ্চে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় জামাত-শিবির।
২৪ ফেব্রুয়ারি ইসলামিক দলগুলির ডাকা হরতালে রাজধানী ঢাকা শহরে গাড়িঘোড়া চলে। হরতালে স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণ না থাকলেও বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষের খবর আসে। মানিকগঞ্জের গোবিন্ধল গ্রামে হরতাল সমর্থক ও গ্রামবাসীর সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে চারজন নিহত হয়। ইসলামের অবমাননার কথা বলে হরতাল সমর্থনকারীরা রাস্তা অবরোধ করে গ্রামবাসীদের ডাকতে থাকে। এতে পুলিশ হস্তক্ষেপ করে কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট ছুঁড়লে বেশ কিছু গ্রামবাসী আহত হয়। তখন এলাকাবাসী লাঠিসোঁটা, রামদা, টেঁটা, চাপাতি, লোহার রডসহ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হরতালকারীদের সঙ্গে মিলে পুলিশের ওপর চড়াও হয়। পুলিশ গুলি চালায়।
২৩ ফেব্রুয়ারি আমার দেশ পত্রিকা শাহবাগ আন্দোলনের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে কুৎসা ছড়াচ্ছে, সব জায়গায় অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও উসকানি দেওয়াচ্ছে —- এই অভিযোগ তুলে পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে অবিলম্বে গ্রেপ্তারের দাবি জানান ইমরান। সংবাদপত্রের পরিবেশক ও হকারদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে তিনি বলেন, ‘উসকানিদাতা ‘‘আমার দেশ’’, ‘‘সংগ্রাম’’ ও ‘‘নয়াদিগন্ত’’ পত্রিকা বিক্রি বন্ধ করে দিন।’ এছাড়া ২৪ ফেব্রুয়ারি হরতাল ভেঙে মিছিল করার আহ্বান রাখেন তিনি।
রায়েরবাজারে মুক্তিযুদ্ধের শেষ মুহূর্তে লাশ পাওয়া গিয়েছিল বাংলাদেশের স্বনামধন্য কিছু মানুষের। সেই রায়েরবাজারে শহীদদের স্মরণ অনুষ্ঠান করে গণজাগরণ মঞ্চ।
পাবনা সদর উপজেলার বাঙ্গাবাড়ী এলাকায় হরতাল সমর্থকরা রাস্তা অবরোধ করলে পুলিশ চড়াও হয়। সংঘর্ষে গুলি চালিয়ে দু’জনকে মেরে ফেলে পুলিশ।
২২ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর সারা দেশে বেশ কিছু মসজিদ থেকে শাহবাগ আন্দোলনের বিপক্ষে মিছিলে যাবার ডাক দেওয়া হয়। এর পরেই বিক্ষোভ মিছিল ও ব্যাপক ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া শুরু করে ইসলামপন্থী দলগুলির কর্মীরা। শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের আদলে দেশের বিভিন্ন জায়গায় গড়ে তোলা মঞ্চ ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদ বেদীগুলিতে ভাঙচুর চালিয়ে আগুন দেওয়া হয়। কোথাও কোথাও জাতীয় পতাকা পোড়ানো হয়। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে হামলা চালানো হয়, সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালানো হয়। এই দিন পুলিশের সঙ্গে চারজন পুলিশের গুলিতে মারা যায়। রাজধানী ঢাকাতে ব্যাপক তাণ্ডব চালায় জামাত-শিবির সহ বিভিন্ন ইসলামিক সংগঠনের কর্মীরা। চট্টগ্রামে আন্দরকিল্লা মোড়ে সমাবেশ শুরু করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, হেফাজতে ইসলামসহ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দল, এবং তা গড়ায় সাংবাদিকদের সঙ্গে সংঘর্ষে। প্রেস ক্লাবে আক্রমণ করে দলগুলি, গণ জাগরণ মঞ্চের ব্যানারও পোড়ানো হয়। বিকেলে এই তাণ্ডবের প্রতিবাদে পালটা মিছিল ইসলামিক সংবাদমাধ্যমগুলির অফিস ভাঙচুর করে। রাজশাহী শহরের সাহেব বাজার এলাকায় জুমার নামাজের পর জামায়াত-শিবিরকর্মীরা তিনটি সংগঠনের ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। তাঁরা গণজাগরণ মঞ্চ ও কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক ভাঙচুর করে। গুড়া শহরের সাতমাথায় জুমার নামাজের পর জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা গণজাগরণ মঞ্চে আগুন দেয়। তাঁরা জাতীয় পতাকা, বঙ্গবন্ধু ও জাহানারা ইমামের ছবি পোড়ায়। সিলেটে জামাত সহ বেশ কয়েকটি দলের মিছিল শহীদ মিনার ও মঞ্চ ভাঙচুর করে ও তারপর কিছু বেসরকারী ব্যাঙ্কে হামলা চালায়। ঝিনাইদহে বাজারের মধ্যে জামাত-শিবিরের মিছিলের সঙ্গে বাসিন্দাদের সংঘর্ষ বাধে। গাইবান্ধায় জামাত শিবিরের মিছিল গণজাগরণ মঞ্চ ভাঙার পর পুলিশ গুলি চালিয়ে দুই জামাত কর্মীকে মেরে ফেলে।
দেশজুড়ে জামাত শিবিরের এই তাণ্ডবের বিরুদ্ধে গণ প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য ফের বিকেল থেকে শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরে অবস্থান শুরু হয়। রোববার ২৪ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে ফের একবার হরতালের ডাক দেয় জামাত সহ বেশ কিছু ইসলামিক সংগঠন। এই হরতাল প্রত্যাখ্যান করার ডাজ দেয় প্রজন্ম চত্বর। রাজধানী ঢাকায় বাংলাদেশ সেনবাহিনী টহল দিতে শুরু করে।
২১ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরে ব্যাপক সমাবেশ। কেবল ছাত্রনেতারাই বক্তব্য রাখবে ঠিক হয় আজকের মহাসমাবেশে। সন্ধ্যায় শাহবাগের মহাসমাবেশ থেকে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক ইমরান এইচ সরকার। তার মধ্যে সরকারকে আলটিমেটাম দেওয়া হয়, আগামী ২৬ মার্চের আগে একাত্তরের ঘাতক ও গণহত্যায় নেতৃত্বদানকারী জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে সংশোধিত ট্রাইব্যুনালস আইন অনুযায়ী অভিযোগ গঠন এবং জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধে আইনি-প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। এছাড়া দাবি করা হয়, ব্লগার রাজীব, জাফর মুন্সি, বাহাদুর মিয়া ও কিশোর রাসেল হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের সাত দিনের মধ্যে গ্রেপ্তার করতে হবে, অবিলম্বে যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠনের আর্থিক উত্স চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা এবং এ বিষয়ে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-প্রক্রিয়া গতিশীল করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে স্থায়ী রূপ দেওয়া, জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাস বন্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান জোরদার করা, সাম্প্রদায়িক উসকানিদাতা গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রভৃতি। প্রজন্ম চত্বরে কোরাণ, গীতা, বাইবেল এবং ত্রিপিটক থেকে পাঠ হয়। আপাতত প্রজন্ম চত্বরের অবস্থান উঠে যায়।
শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরের আন্দোলনের ১৭ তম দিন, ২১ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাত থেকে ২৪ ঘন্টা প্রতি তিরিশ সেকেন্ডে একটি ছবি তুলে সেগুলিকে সাজিয়ে এই ভিডিওটি বানানো হয়েছে। পরিকল্পনা মেহদি হাসান।
আন্দোলনের শুরু থেকেই স্লোগানে মুখর শাহবাগ। এসব স্লোগানের মধ্যে রয়েছে: ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা;’ ‘একাত্তরের হাতিয়ার, গর্জে ওঠো আরেকবার;’ ‘বীর বাঙালির হাতিয়ার, গর্জে ওঠো আরেকবার;’ ‘জামায়াত মারার হাতিয়ার, গর্জে ওঠো আরেকবার;’ ‘শিবির মারার হাতিয়ার, গর্জে ওঠো আরেকবার;’ ‘জামায়াতের আস্তানা, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও;’ ‘সাম্প্রদায়িকতার আস্তানা, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও;’ ‘জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো;’ ‘পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা, পাকিস্তানেই ফিরে যা;’ ‘লাখো শহীদ ডাক পাঠাল, সারা বাংলায় খবর দে, সারা বাংলা ঘেরাও করে জামায়াত-শিবির কবর দে;’ ‘জামায়াত-শিবির রাজাকার, এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়;’ ‘বাংলাদেশের মাটিতে জামায়াত-শিবিরের ঠাঁই নাই;’ ‘আমাদের ধমনিতে শহীদের রক্ত, এই রক্ত কোনো দিনও বৃথা যেতে দেব না;’ ‘আর কোনো দাবি নাই, রাজাকারের ফাঁসি চাই;’ ‘জামায়াতে ইসলাম, মেড ইন পাকিস্তান;’ ‘এসো ভাই এসো বোন, গড়ে তুলি আন্দোলন’—এসব স্লোগানে নতুন এক কাব্যের জন্ম হয় শাহবাগে। আর সব স্লোগানের শেষ ছিল: ‘জয় বাংলা’।
অসংখ্য স্লোগান উঠলেও শাহবাগের সবচেয়ে আলোচিত ও বড় স্লোগান: তুই রাজাকার। নতুন এই স্লোগান এবং নতুন এক বর্ণমালা পুরো শাহবাগকে উজ্জীবিত করেছে। বিশেষ করে ‘স্লোগান-কন্যা’ লাকী আক্তার যখনই সমাবেশ মঞ্চে উঠে এই স্লোগান দেওয়া শুরু করেছেন, তখন পুরো সমাবেশ নতুন প্রাণ পেয়েছে।
বর্ণমালাভিত্তিক ‘তুই রাজাকার’ স্লোগান ক্রমিকটির শুরুতেই রয়েছে: ‘ক-তে কাদের মোল্লা।’ সমস্বরে সমস্বরে উত্তর: ‘তুই রাজাকার, তুই রাজাকার।’ এরপর যথাক্রমে—‘ক-তে কামারুজ্জামান।’ সমস্বরে উত্তর: ‘তুই রাজাকার, তুই রাজাকার।’ ‘গ-তে গোলাম আযম।’ সমস্বরে উত্তর: ‘তুই রাজাকার, তুই রাজাকার।’ ‘স-তে সাকা।’ সমস্বরে উত্তর: ‘তুই রাজাকার, তুই রাজাকার।’ ‘ম-তে মুজাহিদ।’ সমস্বরে উত্তর: ‘তুই রাজাকার, তুই রাজাকার।’ ‘ন-তে নিজামী।’ সমস্বরে উত্তর: ‘তুই রাজাকার, তুই রাজাকার।’ ‘স-তে সাঈদী।’ সমস্বরে উত্তর: ‘তুই রাজাকার, তুই রাজাকার।’
২০ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীতে ছাত্র শিবির ও আওয়ামি লিগ সমর্থকদের মারপিট। জামাত নেতা গ্রেফতারের প্রতিবাদে হরতাল। চট্টগ্রামে আওয়ামি লিগের ক্যাডারদের একটি ইসলামিক পাঠাগার ভাঙচুর।
১৯ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ আন্দোলনকে ইসলাম বিরোধী আখ্যা দিয়ে তার প্রতিরোধের ডাক দিয়ে বিভিন্ন ইসলামি সংগঠনের প্রচার বিক্ষোভ চলতে থাকে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায়। কিছু কিছু জায়গায় ‘নাস্তিক ব্লগার’দের ফাঁসি চেয়ে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি চট্টগ্রামে এক সমাবেশে শাহবাগ আন্দোলনের প্রতি তাদের সুর পালটে ফেলে। সমাবেশ থেকে অভিযোগ করা হয়, ‘যারা ইসলামের ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত দিচ্ছে, সরকার তাদের জাতীয় বীর বানানোর ষড়যন্ত্র করছে’। অন্যদিকে শাসক ১৪ দলের সমাবেশ থেকে শাহবাগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানানো হয়, জামাত শিবির নিষিদ্ধ করার দাবি করা হয়, আমার দেশ-সংগ্রাম-ইনকিলাব-নয়া দিগন্ত-দিগন্ত টিভি প্রভৃতি যে সব সংবাদমন্থন আন্দোলনের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারে সামিল হয়েছে, তাদের নিষিদ্ধ করার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।
অন্যদিকে শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরে ছাত্র যুবদের অবস্থান চলতে থাকে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের সংহতি জ্ঞাপনও চলতে থাকে। বাংলাদেশের জাতীয় ফুটবল দলের প্রাক্তন অধিনায়ক আরিফ খান সংহতি জানান। ‘ইসলাম বিরোধী’ আখ্যা ও অন্যান্য সমালোচনার মুখে পড়ে কিছু পরিবর্তন করা হয় প্রজন্ম চত্বরের কর্মসূচীতে। যেমন, বারডেম হাসপাতালের সামনের রাস্তা কিছুটা ছেড়ে দেওয়া হয়। আজান ও নামাজের জন্য মাইকে কিছু সময়ের জন্য বিরতি দেওয়া হয়। এ সময় বন্ধ রাখা হয় স্লোগান, প্রতিবাদী গান ও কবিতা আবৃত্তি।
১৮ ফেব্রুয়ারি দুপুরে বিচারপতি মিজানুর রহমান ভূইয়ার পক্ষে তাঁর জমাদার হাইকোর্টের বিচারপতিদের ঘরে ঘরে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টের খামে করে ব্লগার রাজীব হায়দারকে ‘মুরতাদ’ আখ্যায়িত করে লেখা একটি প্রতিবেদন দিয়ে আসেন। প্রধান বিচারপতি তাঁকে সংশোধন হতে বলেন। শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের গণজাগরণ মঞ্চ, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি এবং একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি বিচারপতি মিজানুর রহমান ‘ভূইয়ার পদত্যাগের দাবি করে। জামাত-ই-ইসলামি প্রভাবিত পত্রিকা ‘আমার দেশ’ -এ শাহবাগ আন্দোলনের সংগঠক ব্লগার এবং খুন হওয়া রাজীব হায়দার-এর বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত কুৎসা শুরু হয়। প্রয়াত রাজীবের ব্লগ থেকে তাঁর ইসলাম ধর্মের সমালোচনাকে তুলে ধরে শাহবাগ আন্দোলনকে নাস্তিকদের দ্বারা পরিচালিত এবং ইসলাম বিরোধী একটি আন্দোলন বলে দেশজুড়ে ব্যাপক প্রচার শুরু করে ইসলাম ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলি। অন্যদিকে সংসদে রাজীব হায়দারের হত্যা নিয়ে তীব্র নিন্দা ও শোক প্রস্তাব নেওয়া হয়।
জামাত-ই-ইসলামি আজ ধর্মঘট ডাকে। শাহবাগ প্রজন্ম চত্বর থেকে জামাত ও ছাত্রশিবির বিরোধী এবং হরতালের বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়া হয় এবং হরতাল প্রতিরোধের ডাক দেওয়া হয়। ধর্মঘটে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষে ধর্মঘট সমর্থনকারীদের হামলায় বাস চাপা পড়ে একজন এবং বাসের মধ্যেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে একজন মারা যায়। এছাড়া পুলিশের গুলিতে নিহত হয় এক ছাত্র শিবির (জামাত-ই-ইসলামির সংশ্লিষ্ঠ ছাত্র সংগঠন) কর্মী, আহত হয় আরও বেশ কয়েকজন। শিবির কর্মী মারা যাওয়ার ফলে পরদিন কুমিল্লায় আধবেলা হরতাল ডাকা হয়।
১৭ ফেব্রুয়ারি আল্লামা সাঈদী মুক্তি পরিষদ ও ইসলাম নির্মূল প্রতিরোধ কমিটি কক্সবাজারের ব্যানারে শুক্রবার মিছিলের চেষ্টাকালে পুলিশের বেপরোয়া গুলিবর্ষণে ৫ জন নিহত হওয়ার প্রতিবাদে জেলায় ডাকা লাগাতার ৪৮ ঘণ্টার হরতালের প্রথম দিন অতিবাহিত হয়েছে। এ হরতালে পূর্ণ সমর্থন জানায় জামায়াত-ই-ইসলামি।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনেরও বিচার করা যাবে। অর্থাৎ রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে জামায়াত-ই-ইসলামিকেও যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিচারের আওতায় আনা যাবে। আজ রবিবার জাতীয় সংসদে এ-সংক্রান্ত বহুল আলোচিত আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনালস) (সংশোধন) বিল-২০১৩ সংশোধিত আকারে সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়েছে। আইনটি পাস হওয়ায় ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনেরও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করার পথ উন্মুক্ত হল। এ ছাড়া আইনে সরকার ও বাদী পক্ষের আপিল করার সমান সুযোগের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ৬০ দিনের মধ্যে আপিল নিষ্পত্তির কথা বলা হয়েছে আইনে। আইনটি ২০০৯ সালের ১৪ জুলাই থেকে কার্যকর হবে। আগে সরকারপক্ষের শুধু খালাসের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ ছিল। আইনে শাস্তি কমানোর জন্য বাদী পক্ষের আপিলের সুযোগ থাকলেও শাস্তি বাড়ানোর জন্য আপিল করার কোনো সুযোগ সরকারপক্ষের ছিল না। এখন যে কোনো রায়ের বিরুদ্ধে সরকার আপিল করতে পারবে। আইনটি পাস হওয়ার মাধ্যমে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের আন্দোলনকারীদের একটি দাবি পূরণ হল।
১৬ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারে সাঈদী মুক্তিপরিষদের মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণে ৩ জন নিহত হওয়ার প্রতিবাদে ইসলামি ছাত্রশিবির সিলেট মহানগরের উদ্যোগে শান্তিপূর্ণ মিছিলে সিলেট কোতোয়ালী থানা পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। কোতোয়ালী থানার অফিসার ইনচার্জ আতাউর রহমান বাবুলের নির্দেশে মিছিলে পিছন থেকে পুলিশ গুলি চালায়। গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নগরীর চৌহাট্টার আরএন টাওয়ারের সামনে থেকে শুরু হওয়া মিছিলে পুলিশ কমপক্ষে ৫০ রাউন্ড শর্টগানের গুলিবর্ষণ করে। পুলিশের গুলিতে মহানগর শিবির নেতা রাহাত খান ও ছাদিক আহমদসহ ৫ জন গুলিবিদ্ধ হন। ইসলামি ছাত্রশিবির সন্দেহে নগরীর বিভিন্ন জায়গা থেকে পুলিশ কমপক্ষে ২০ জনকে আটক করেছে।
কোতোয়ালী থানা সূত্রে জানা যায়, বিক্ষুব্ধ ছাত্রজনতার সাথে সংঘর্ষে পুলিশের এসি (ট্রাফিক) রাজিব দাসসহ পুলিশের ৭ জন সদস্য আহত হয়েছেন। শিবিরের শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ইসলামী ছাত্রশিবির রবিবার সিলেট জেলা ও মহানগরে ৬টা থেকে ২টা পর্যন্ত অর্ধদিবস হরতাল আহবান করেছে।
জামায়াত-শিবিরকে আর ছাড় দেয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘জামায়াত-শিবির কোনো গণতান্ত্রিক দল নয়, তারা সন্ত্রাসী দল। এদেশে তাদের রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই।’ নিহত ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারের মিরপুরের বাসায় শনিবার বিকেলে তার পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানাতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। বিপরীতে, রাজীব নিহত হওয়ার ঘটনার জন্য জামায়াত-ই-ইসলামি ও ইসলামি ছাত্রশিবিরকে দায়ী করে অপপ্রচার চালানো এবং আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে খতম ও বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ড: পিয়াস করীম এবং অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুলের চামড়া তুলে নেওয়ার জন্য ছাত্রলীগের হুমকির তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে জামায়াত-ই-ইসলামির ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান আজ বিবৃতি দিয়েছেন।
১৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগের আন্দোলনের ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার শোভন আজ রাতে ঢাকার মিরপুরে সন্ত্রাসী দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত হন।
১৪ ফেব্রুয়ারি সরকার শাহবাগের প্রতিবাদীদের দাবির দিকে নজর রেখে আইসিটি আইনের খসড়া সংশোধনী জাতীয় সংসদে পেশ করে।
১২ ফেব্রুয়ারি সারা দেশ জুড়ে বিকেল চারটে থেকে চারটে তিন মিনিট পর্যন্ত তিন মিনিটের নীরবতা পালন সংগঠিত করা হয়। ঢাকায় ট্রাফিক স্তব্ধ হয়ে যায়, হাজার হাজার মানুষ নীরবে রাস্তায় নেমে আসে ও মানব-শৃঙ্খল গঠন করে, শের-ই-বাংলা ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের খেলা চলাকালীন ক্রিকেটার ও দর্শকেরা তিন মিনিট খেলা বন্ধ রাখে। সাংসদ এবং পুলিশ বাহিনীও এই নীরবতা পালনে যোগদান করে।
৮ ফেব্রুয়ারি বিকেলবেলায় শাহবাগ স্কোয়ারে হাজার হাজার মানুষের মিছিল হয়। অন্যত্রও মিছিল হয়। এইদিন বোয়ান-এর কনভেনর ইমরান এইচ সরকার শাহবাগে একটি শপথ পাঠ করেন : ‘আমরা শপথ করছি একাত্তরে যে সমস্ত ঘৃণ্য রাজাকার গণহত্যা ও ধর্ষনের মতো মানবতা বিরোধী অপরাধ করেছে সেই জামায়াত-ই-ইসলামির রাজনীতি বন্ধ না হওযা পর্যন্ত এ আন্দোলন অব্যাহত রাখব। আমরা শপথ করছি যুদ্ধাপরাধী ও জামাত শিবিবের রাজনীতি নিষিদ্ধ ও তাদের নাগরিকত্ব বাতিল না হওয়া পর্যন্ত রাজপথে ও অনলাইনে সক্রিয় থাকব। আমরা শপথ করছি। ৭৫ পরবতী যে সমস্ত অপরাধীকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে তাদেরকে ট্রাইবুনালের আওতাধীন করব। যুদ্ধাপরাধীদের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ইসলামী ব্যাংক, ইবনেসিনা, রেটিনা ফোকাসসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বয়কট করব। আমরা মনে রাখব এগুলির মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে তারা এ দেশে স্বাধীনতা বিরোধী অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এক কথায় রাজাকার আল বদরদের সকল সামাজিক ও ব্যবসায়িক সংস্কৃতি নিষিদ্ধ করার লক্ষ্যে কাজ করব। এমনকী যে সকল প্রতিষ্ঠান শিশুদের সাম্প্রদায়িকতায় উদ্বুদ্ধ করতে কাজ করছে তাদেরকেও বয়কট করব। আমরা আরও শপথ করছি, দেশে গৃহযুদ্ধের হুমকি দিয়ে যে সমস্ত জামাত শিবির রাষ্ট্রদ্রোহসম অপরাধ করেছে। পত্রিকা খবর ও টিভির ফুটেজ দেখে গ্রেফতার করে অবিলম্বে বিচারের আওতায় আনব। যুদ্ধাপরাধীদের গণমাধ্যম নয়াদিগন্ত, দিগন্ত টিভি, আমার দেশ, সংগ্রাম, সোনার বাংলা ব্লগ বয়কট করব। কোনো অফিস বা বাসায় যুদ্ধাপরাধীদের পত্রিকা রাখব না।’
৭ ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভকারীরা সকাল আটটা থেকে জাতীয় সংগীত গাইতে শুরু করে। শাহবাগ স্কোয়ারকে ‘প্রজন্ম চত্বর’ নামকরণ করা হয়েছিল আগেই। সেখানে জমায়েতে অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে। অন্যত্র এবং অন্য দেশেও বাংলাদেশিদের মধ্যে প্রতিবাদ শুরু হয়। দাবি করা হয় : ১। আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই; ২। সমস্ত যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই; ৩। জামাত-ই-ইসলামিকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করা হোক এবং ৪। সমস্ত জামাত-এর প্রতিষ্ঠান বয়কট করা হোক।
৫ ফেব্রুয়ারি আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল : ১। পল্লবকে খুন; ২। মুক্তিযুদ্ধের কবি মেহেরুন্নেসা, তাঁর মা এবং দুই ভাইকে খুন; ৩। খান্দোকার আবু তালেবকে খুন; ৪। ঘাটার চর এবং ভাওয়াল খানবাড়িতে হত্যাকাণ্ড; ৫। আলুব্দি গণহত্যা (৩৪৪ জন) এবং ৬। হজরত আলি এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা। ৪নং অভিযোগ ছাড়া বাকিগুলিতে তাঁর দোষ প্রমাণিত হয়। ৫ ও ৬নং অভিযোগের জন্য তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়; ১, ২ ও ৩নং অভীযোগের জন্য ১৫ বছরের কারাদণ্ড হয়। আগের দিনই জামাত-ই-ইসলামি তাদের নেতা আবদুল কাদের মোল্লার বিচারের বিরুদ্ধে ৫ তারিখ সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল। রায় ঘোষণার পর অনলাইনে ফেসবুক, টুইটার ও ব্লগগুলিতে বহু মানুষ একে অত্যন্ত লঘু দণ্ড হিসেবে প্রতিবাদ করতে শুরু করে। ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক (বোয়ান) এই রায়ের প্রতিবাদ করার ডাক দেয়। বিকেলের মধ্যেই অনলাইন যোগাযোগের মাধ্যমে ঢাকার শাহবাগ স্কোয়ারে প্রতিবাদকারীরা জমায়েত হতে শুরু করে। রাস্তার ওপর ছবি এঁকে, কার্টুন এঁকে এবং কাদের মোল্লা সহ যুদ্ধাপরাধীদের … পুড়িয়ে প্রতিবাদ করা হয়। রাতভর প্রতিবাদ চলতে থাকে।
২১ জানুয়ারি ২০১৩ গণহত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, গুমখুন ও অত্যাচারের আটটি অভিযোগের সাতটি প্রমাণের ভিত্তিতে মৌলভি আবুল কালাম আজাদকে ট্রাইবুনাল ফাঁসির আদেশ দেয়। আজাদ বিচারের জন্য অনুপস্থিত ছিলেন। সরকার তাঁর পক্ষে উকিল নিয়োগ করেছিল। কিন্তু তিনি জানান, ‘আজাদের পরিবারের অসহযোগিতা’র কারণে তিনি কোনো সাক্ষী হাজির করতে পারেননি। পুলিশের অনুমান আজাদ পাকিস্তানে পালিয়ে গেছেন।
২২ মার্চ ২০১২ সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তরান্বিত করতে দ্বিতীয় ট্রাইবুনাল আইসিটি-২ গঠন করে।
১৮ ডিসেম্বর ২০১১ আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আইনানুগ দরখাস্ত পেশ করা হয়।
২ আগস্ট অভিযুক্ত মতিয়ুর রহমান নিজামি, আলি আহ্সান মুহাম্মদ মুজাহিদ, মুহাম্মদ কামারুজ্জমান ও আবদুল কাদের মোল্লাকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেল থেকে ট্রাইবুনালে নিয়ে আসা হয়। আদালত এঁদের পরবর্তী নির্দেশের আগে পর্যন্ত কারাগারে রাখার নির্দেশ দেয়।
২৫ মার্চ ২০১০ সরকার বিচারের জন্য মহম্মদ নিজামুল হককে চেয়ারম্যান, এ টি এম ফজলে কবীর ও এ কে এম জাহির আহমেদকে নিয়ে তিন সদস্যের ট্রাইবুনাল, সাত সদস্যের তদন্তকারী সমিতি এবং ১২ সদস্যের প্রসিকিউশন দল গঠন করে।
৯ জুলাই ১৯৭৩-এর আইনটির নতুন ধারা সংযোজনের বিল সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এই সংযোজন অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী দলকেও সাজা দেওয়া যাবে এবং সরকার অভিযুক্ত সম্পর্কিত নির্দেশের বিরুদ্ধে অ্যাপিল কোর্টে অ্যাপিল করতে পারবে। আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ জানান, একমাসের মধ্যেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হতে পারবে।
২৫ মার্চ সরকার ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম্স (ট্রাইবুনাল্স) অ্যাক্ট ১৯৭৩ অনুসারে ওই বিচার করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৭৩ সালের আইনকে সংশোধন করার জন্য ল কমিশনকে নিয়োগ করা হয়।
২৯ জানুয়ারি ২০০৯ আওয়ামি লিগের সাংসদ মাহমুদ-উস-সামাদ চৌধুরি জাটীয় সংসদে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য প্রস্তাব আনেন এবং সেখানে সর্বসম্মতিক্রমে তা পাশ হয়। সরকারকে বিচার শুরু করার আহ্বান জানানো হয়।
২০০৮ সাধারণ নির্বাচনের আগে দেশের এক বড়োসংখ্যক মানুষ, বিশেষত যুবসম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের অপরাধীদের বিচার দাবি করে। এই দাবি একটি জাতীয় দাবি হয়ে ওঠায় আওয়ামি লিগের নেতৃত্বে ১৪ দলের জোট তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে এটিকে যুক্ত করে। বিপরীতে, বাংলাদেশ ন্যাশনাল পার্টি বিএনপি এবং জামাত-ই-ইসলামি সহ ৪ দলের জোটের বড়ো বড়ো নেতারা যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত ছিল। ২৯ জানুয়ারি নির্বাচনে ১৪ দলের জোট জয়লাভ করে।
Leave a Reply