২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে অবস্থান করছে কলকাতা ও আশেপাশের এলাকার বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনের কর্মী-পাঠক বৃন্দ। তাদের প্রচারপত্রটি নিচে দেওয়া হল#
প্রতিবছর যখন আজকের দিনটা ঘুরে আসে, উদ্যাপনের পাশাপাশি আমরা নিজেদের দিকে ফিরে তাকাই, নিজেদের মাতৃভাষার দৈন্যতা নিয়ে একটু হাহাকার করি। একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু বাংলাভাষার শহিদদের স্মরণ করার দিনই নয়, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আমরা আজ প্রাত্যহিক জীবন-যুদ্ধে এতখানি জেরবার, অর্থ রোজগারের তাড়নায় ভুলতে বসেছি নিজের মাকে, নিজের সমাজ-সংস্কৃতিকে, নিজের মাতৃভাষাকে।
কিন্তু এবারের একুশে ফেব্রুয়ারি এই গ্লানিবোধ থেকে আমাদের খানিকটা মুক্তি দিয়েছে। আজ দু-সপ্তাহ অতিক্রান্ত, বাংলার নবপ্রজন্ম ঢাকার শাহবাগ স্কোয়ারে রাতভর অবস্থানে শামিল হয়েছে; হাজার হাজার ছেলেমেয়ে নিজের স্বাধীনতা ও সাবালকত্ব ঘোষণা করেছে সোচ্চারে।
৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে জামাত-ই-ইসলামির নেতা আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ঘোষিত হয়। তাঁর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের কবি মেহেরুন্নেসা, তাঁর মা এবং দুই ভাই সহ বহু ব্যক্তি ও গণহত্যার অভিযোগ ছিল। যুদ্ধাপরাধীদের জন্য গঠিত ট্রাইবুনালে তাঁর দোষ প্রমাণিত হয় এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। আগের দিনই জামাত-ই-ইসলামি তাদের নেতা আবদুল কাদের মোল্লার বিচারের বিরুদ্ধে ৫ তারিখ সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল। রায় ঘোষণার পর অনলাইনে ফেসবুক, টুইটার ও ব্লগগুলিতে বহু যুবক-যুবতী একে অত্যন্ত লঘু দণ্ড হিসেবে প্রতিবাদ করতে শুরু করে। ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক (বোয়ান) এই রায়ের প্রতিবাদ করার ডাক দেয়। বিকেলের মধ্যেই অনলাইন যোগাযোগের মাধ্যমে ঢাকার শাহবাগ স্কোয়ারে প্রতিবাদকারীরা জমায়েত হতে শুরু করে। রাস্তার ওপর ছবি এঁকে, কার্টুন এঁকে এবং কাদের মোল্লা সহ যুদ্ধাপরাধীদের কুশপুত্তলিকা পুড়িয়ে প্রতিবাদ করা হয়। রাতভর প্রতিবাদ চলতে থাকে। উপস্থিত জনতা যখন দেখে এই সমাবেশ কোনো রাজনৈতিক দলের নয়, তখন সেখানে আরও অজস্র মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ঢল নামে।
নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের এই জাগরণ শুরু হয়েছিল দু-বছর আগে তিউনিসিয়া, মিশর, স্পেন, ইজরায়েল, আমেরিকায়। তারা বলেছিল, ‘আমাদের কোনো নেতা নেই, প্রতিনিধি নেই, আমরা মধ্যস্থতা চাই না’, আমরাই আমাদের কথা বলব। তার স্ফূরণ আমরা দেখেছি সম্প্রতি দিল্লির এক ছাত্রীর নির্মম ধর্ষণ ও মৃত্যুর ঘটনায় দেশের সমস্ত শহরে; এমনকী আমাদের কলকাতার রাস্তায় একত্রিত হয়েছিল প্রতিবাদী ছাত্র-ছাত্রী, যুবক-যুবতীরা। এবার দল-মত-ধর্ম নির্বিশেষে নবপ্রজন্মের এই স্বাধীন আত্মপ্রকাশ ঘটল বাংলাদেশের শাহবাগ স্কোয়ারে। নিমেষে তা ছড়িয়ে পড়ল দেশ থেকে দেশান্তরে, বিশ্বময়, লক্ষ লক্ষ বাঙালির মধ্যে।
৮ ফেব্রুয়ারি প্রজন্ম চত্বরে (শাহবাগ স্কোয়ারের নতুন নাম) একটি শপথ নেওয়া হয় : ‘আমরা শপথ করছি একাত্তরে যে সমস্ত ঘৃণ্য রাজাকার গণহত্যা ও ধর্ষনের মতো মানবতা বিরোধী অপরাধ করেছে সেই জামাত-ই-ইসলামির রাজনীতি বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত এ আন্দোলন অব্যাহত রাখব। আমরা শপথ করছি যুদ্ধাপরাধী ও জামাত শিবিবের রাজনীতি নিষিদ্ধ ও তাদের নাগরিকত্ব বাতিল না হওয়া পর্যন্ত রাজপথে ও অনলাইনে সক্রিয় থাকব। আমরা শপথ করছি ১৯৭৫ পরবতী যে সমস্ত অপরাধীকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে তাদেরকে ট্রাইবুনালের আওতাধীন করব। যুদ্ধাপরাধীদের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ইসলামি ব্যাংক, ইবনেসিনা, রেটিনা ফোকাসসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বয়কট করব। আমরা মনে রাখব এগুলির মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে তারা এ দেশে স্বাধীনতা বিরোধী অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এক কথায় রাজাকার আল বদরদের সকল সামাজিক ও ব্যবসায়িক সংস্কৃতি নিষিদ্ধ করার লক্ষ্যে কাজ করব। এমনকী যে সকল প্রতিষ্ঠান শিশুদের সাম্প্রদায়িকতায় উদ্বুদ্ধ করতে কাজ করছে তাদেরকেও বয়কট করব। আমরা আরও শপথ করছি, দেশে গৃহযুদ্ধের হুমকি দিয়ে যে সমস্ত জামাত শিবির রাষ্ট্রদ্রোহসম অপরাধ করেছে। পত্রিকা খবর ও টিভির ফুটেজ দেখে গ্রেফতার করে অবিলম্বে বিচারের আওতায় আনব। …’
এই শপথবাক্যের মধ্যে ফুটে উঠেছে বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের গভীর উদ্বেগ আর ক্ষোভ। এই উদ্বেগ আর ক্ষোভ কি আজ সমগ্র উপমহাদেশ জুড়েই নতুন প্রজন্মের মধ্যে দানা বাঁধেনি? কীভাবে সাম্প্রদায়িকতার নাগপাশে বেঁধে রাখা হয়েছে ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের সমাজজীবনকে; শুধু সাম্প্রদায়িক বলে চিহ্নিত দলগুলিই নয়, ডান-বাম রাজনৈতিক দলগুলি কীভাবে জাত, ধর্ম আর জাতিগত বিদ্বেষের বিষে রাজনীতিকে কলুষিত করে চলেছে, আমরা কি তা অনুভব করি না? বাংলাদেশে তা আজ এমন পর্যায়ে এসেছে যে এনজিও এবং সামাজিক ও আর্থিক সংগঠনগুলোতেও ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিদ্বেষকে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই সংকট-মুহূর্তে যখন সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতা দখলের গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়েছে, তখন বাংলাদেশের যুবসমাজ উঠে দাঁড়িয়েছে। ২০০৮ সাল থেকেই তারা একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তির দাবি তুলেছিল। আওয়ামি লিগ নির্বাচনে ক্ষমতা দখলের জন্য এই দাবিকে তাদের ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হয়েছিল। আমরা জানি, বাংলাদেশে প্রায় দুই লক্ষ নারী মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষিত হয় এবং তাদের গর্ভে অনেক যুদ্ধশিশু জন্ম নেয়। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে শহিদের সংখ্যাটিকে ত্রিশ লক্ষ হিসেবে অনুমান করা হয়। যুদ্ধের সময় প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল, যারা সে সময় দেশত্যাগ না করলে হয়তো গণহত্যার শিকার হত। কিন্তু এতদিন কেন এর বিচার হয়নি? এবার এগিয়ে এসেছে যুবসমাজ।
আমরা মনে করি আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির এই সংকট-মুহূর্তে, আমাদের সমাজ ও রাজনীতির বিপন্নতায় প্রকৃত কাণ্ডারি হয়ে উঠতে পারে আমাদের ছেলেমেয়েরা। আসুন আমরা নতুন প্রজন্মের এই বিদ্রোহে সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিই।
২১শে ফেব্রুয়ারি ২০১৩
তবু বাংলার মুখ, অনীক, সপ্তাহ, এবং জলার্ক, জনপথ, মন্থন, একক মাত্রা, রবিশস্য পত্রিকা
নয়া বাংলা উদ্যোগ, ভাষা সংস্কৃতি স্বাধিকার মঞ্চ, লিট্ল ম্যাগাজিন সমন্বয় মঞ্চ,
ফ্রেন্ডস অব ডেমোক্রেসি ও কলিকাতা লিট্ল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র
Leave a Reply