বাংলাদেশ এখন এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের দিকে এগিয়ে চলেছে। এক প্রতিহিংসার আবর্তে তলিয়ে যাচ্ছে গোটা দেশ, দেশের মানুষ। ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার শাহবাগ স্কোয়ারে এক স্বতঃস্ফূর্ত যুববিদ্রোহের মধ্য দিয়ে উঠে এসেছিল একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি। ২৮ ফেব্রুয়ারি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে জামাতের সমর্থকেরা প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে পড়ে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। রংপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিরাজগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁ, চাপাইনবাবগঞ্জ, নোয়াখালি, মৌলভিবাজার, সাতক্ষীরা, গাইবান্ধা, কুমিল্লা, নাটোর, যশোর, লক্ষ্মীপুর, পাবনা এবং ঢাকায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়, হতাহত হয় বহু মানুষ।
একদিকে, শাহবাগের যুবক-যুবতীরা হেস্তনেস্ত চায়। তারা বলছে, বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রে যারা রাজনীতি করবে, তাদের সবাইকে অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি হতে হবে। কেউ সরকারি দল হবে, কেউ বিরোধী দল। কিন্তু স্বাধীনতা বিরোধী কোনো দল থাকতে পারবে না। অন্যদিকে, বিপরীত মেরুতে জামাত-ই-ইসলামি এবং অন্যরা বলছে, নব্বই ভাগ মুসলমানের ভূখণ্ডে আল্লার বিধান ছাড়া অন্য কারও বিধান চলতে পারে না।
আমরা জানি, বাংলাদেশে প্রায় দুই লক্ষ নারী মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষিত হয় এবং তাদের গর্ভে অনেক যুদ্ধশিশু জন্ম নেয়$ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে শহিদের সংখ্যাটিকে ত্রিশ লক্ষ হিসেবে অনুমান করা হয়; মতান্তরে তা তিন থেকে পাঁচ লক্ষ$ যুদ্ধের সময় প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল, যারা সে সময় দেশত্যাগ না করলে হয়তো গণহত্যার শিকার হত। কিন্তু গত চল্লিশ বছর সেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সমস্ত আয়োজনই ব্যর্থ হয়েছে। এবার এগিয়ে এসেছে যুবসমাজ। এই যুবক-যুবতীরা বলছে, এটা আমাদের ব্যক্তিগত আন্দোলন। অর্থাৎ এই বিদ্রোহের মধ্যে রয়েছে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের এক ব্যক্তিগত আক্রোশ। কারণ সেদিনের লক্ষ লক্ষ লাঞ্ছিত ধর্ষিত নিহতদের পরিবারগুলির এখনকার প্রজন্মের মধ্যে রয়ে গেছে সেই ক্রোধ ও ঘৃণার বীজ।
আমরা ভারত তথা এই বাংলার মানুষ আমাদের উপমহাদেশের অতীত ভুলে যাইনি। আমরা ভুলিনি আমাদের দেশভাগের কথা, ভুলিনি পূর্ব-পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ গড়ে ওঠার কথা। তবু আজও আমরা অন্তরে বহন করে চলেছি সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ এবং দেশগত পারস্পরিক বিদ্বেষের বিষ। যতই আমরা ‘সেকুলারিজম’-এর কথা আওড়াই না কেন, আমাদের সংস্কৃতি এবং দলীয় রাজনীতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়েছে সেই বিদ্বেষ-বিষ। বাংলাদেশও তা থেকে মুক্ত নয়। সেখানেও মানুষের দুটো মনের টানাপোড়েন রয়েছে। একদিকে বাঙালি মন, অন্যদিকে মুসলমান মন। একদিকে স্বাধীনতাকে রক্ষা করা, অন্যদিকে ইসলামের পবিত্রতাকে রক্ষা করা। এই টানাপোড়েন ইন্টারনেট-ব্লগারদের মধ্যে অনেক আলাপ ও তর্কের জন্ম দিয়েছে। আমরা চাই সেইসব তর্ক উপযুক্ত গুরুত্ব পাক, সমাজে ছড়িয়ে পড়ুক, সমাজই তার সমাধান করুক।
বাংলাদেশের ভাইবোনেরা ভাবুন, প্রতিহিংসা চরিতার্থ হলেই সেই সমাধান হবে কি? যে টানাপোড়েনের শেকড় সমাজের গভীরে প্রোথিত, তাৎক্ষণিক প্রতিহিংসা দিয়ে তার থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে কি?
Leave a Reply