“ |
মালিকরা শ্রমিকদের মূল্যায়ন করে না। তাদের দৃষ্টিতে শ্রমিকরা যেন চোর। সেই কারণে কারখানার দরজা, প্রধান ফটক তালাবদ্ধ করে রাখে। আর তাতে আগুন লাগলে শ্রমিকরা অবরুদ্ধ হয়ে মারা যায়। এটা এক ধরনের হত্যাকাণ্ড। |
নাজমা বেগম, সম্মিলিত গার্মেন্টস ফেডারেশনের সভাপতি |
‘দৈনিক সংগ্রাম’ পত্রিকায় প্রকাশিত (নিশ্চিন্তপুর ঘুরে এসে শাহেদ মতিউর রহমান ও তোফাজ্জল হোসেন কামাল-এর) রিপোর্টের ভিত্তিত#
বাংলাদেশের ঢাকার অদূরে সাভার উপজেলার আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলের নিশ্চিন্তপুরে ‘তুবা’ গ্রুপের ‘তাজরীন ফ্যাশনস’ নামের তৈরি-পোশাক কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ১১০ জন শ্রমিক মারা গেল। ২৪ নভেম্বর শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় আগুন লাগে, কর্তৃপক্ষ ফায়ার অ্যালার্ম বাজায় ছ-টা পঞ্চান্ন মিনিটে। দমকল বাহিনীর ১০টি ইউনিট প্রায় পাঁচ ঘণ্টার চেষ্টায় রাত পৌনে ১২টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। রোববার দুপুরে উদ্ধার অভিযানের সমাপ্তি টেনে কর্তৃপক্ষ জানায়, মৃত ১১০। এর মধ্যে ১০১ জনই পুড়ে মারা গেছে, যাদের অনেককে চেনার কোনো উপায় নেই। কারো কারো ভাঙাচোরা কঙ্কালও মিলেছে। আগুন থেকে বাঁচতে নয় তলা ওই ভবন থেকে লাফিয়ে মারা গেছে সাত মহিলা শ্রমিক সহ নয়জন। তবে লাফিয়ে পড়া অনেকে আহত হলেও প্রাণে বেঁচেছে। পুড়ে যাওয়া শ্রমিকদের মধ্যে ৪৩ জনের লাশের দাবিদার পাওয়া গেছে, বাকি ৫৮টি লাশের দাবিদার পাওয়া যায়নি।
২০০৯ সালে এই কারখানাটি গড়ে ওঠে। মালিক দেলোয়ার হোসেন। তুবা গ্রুপের ওয়েব সাইটের তথ্য অনুযায়ী, ‘তাজরীন ফ্যাশন’ নামের কারখানাটি ছাড়াও মোট ১৩টি পোশাক কারখানা রয়েছে তাদের। এর মধ্যে ‘তাজরীন ফ্যাশন’-এ শ্রমিক-কর্মচারী মিলিয়ে দেড় হাজারের বেশি লোক কাজ করত। কিন্তু শ্রমিকদের মতে, নয়তলা ভবনটির প্রতিটি তলাতেই পোশাক তৈরির কাজ করত প্রায় পাঁচশো শ্রমিক। সে হিসাবে ওই কারখানায় শ্রমিক ছিল সাড়ে ৪ হাজার। ঘটনার দিন শনিবার বিকেল পর্যন্ত রেগুলার ডিউটি শেষে যার যার গন্তব্যে ফিরে যায় প্রায় অর্ধেক শ্রমিক। বাকিরা ছিল ‘ওভারটাইম’ ডিউটিতে।
এছাড়া নয়তলা এই ভবনের অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ফায়ার ফাইটার, উদ্ধারকর্মী ও প্রাথমিক চিকিৎসা কর্মী মিলিয়ে মোট ৩০০ কর্মী এবং ৩৩৫টি অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র থাকার কথা বলা হলেও অগ্নিনির্বাপণে তাদের কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। রোববার দুপুর ১টার দিকে কারখানার বিভিন্ন ফ্লোর ঘুরে দেখা যায়, দ্বিতীয় থেকে অষ্টম তলা পর্যন্ত প্রত্যেক তলায় খুঁটিতে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে আটটি করে অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র। সর্বশেষ চলতি মাসের ৫ তারিখে এগুলো পরীক্ষা করা হয়েছে। আর কর্তৃপক্ষের স্বাক্ষরও রয়েছে তাতে। তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় মেঝেতে দুটি যন্ত্র পড়ে থাকতে দেখা গেলেও সেগুলোর ওপেন রিঙ অক্ষতই ছিল। শুধু অষ্টম তলায় পড়ে থাকা একটি যন্ত্র ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
শ্রমিক মোহাম্মদ রিপু বলেন, ‘ঘটনার সময় ফায়ার অ্যালার্ম বেজে ওঠে। তখন আমরা আগুন লেগেছে ভেবে নামতে গেলে কর্তৃপক্ষ বলে, ‘কিছু হয়নি। অ্যালার্ম নষ্ট হয়ে গেছে। ঠিক করে দিচ্ছি’, বলেই কোলাপসিবল গেটে তালা এঁটে দিয়ে কাজ করতে বলে শ্রমিকদের।’ ওই কারখানার পিওন কামরুল এই তালা লাগিয়ে দেয় বলে জানান আরেক শ্রমিক মো. স্বপন। নয়তলা ওই ভবনে জরুরি নির্গমন ব্যবস্থা বা এই ধরনের কোনো সিঁড়ি ছিল না। আস্তর লাগানোর জন্য ভবনের দক্ষিণ দেওয়ালে বাঁশের মাচা ঝোলানো ছিল, ওই মাচা দিয়ে অনেকে নেমে আসে বলে স্থানীয়রা জানায়। এছাড়া দমকল সূত্রে জানানো হয়েছে, আশপাশে যথেষ্ট পরিমাণ জল না পাওয়ায় আগুন নিয়ন্ত্রণে দেরি হয়েছে। তাজরীন ফ্যাশন কারখানাটিতে যাতায়াতের রাস্তা সরু। ফায়ার ব্রিগেডের একটি গাড়ি প্রবেশ করার পরে অন্য কোনো গাড়ি ভিতরে প্রবেশ করতে না পারায় নিহতের সংখ্যা বেড়েছে। কারখানাটির চারদিকে নিজস্ব কোনো জমি না থাকায় এবং ফায়ার ব্রিগেডের সদস্যরা সঠিকভাবে কাজ করতে না পারায় আগুন নিয়ন্ত্রণ ও উদ্ধার তৎপরতায় ব্যাঘাত ঘটেছে।
জীবন বাজি রেখে ছয়তলায় থাকা সুইং অপারেটর মোঃ মোমিন তাঁর স্ত্রী মুক্ত খাতুনকে বাঁচিয়েছেন। সেই সময়ের বর্ণনা করে তিনি বলেন, শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে আগুন লাগলেও কর্তৃপক্ষ সতর্ক ঘণ্টি বাজায় ছয়টা পঞ্চান্ন মিনিটের দিকে। তারপর ম্যানেজারের দক্ষিণ পাশে থাকা কক্ষ থেকে জোরে গান বাজানো শুরু হয়। কোলাপসিবল গেটেও তালা থাকায় কর্মচারীরা যার যার তলায় আটকা পড়েন। আগুন যেন আমাদের এখানে ছড়াতে না পারে, এ জন্য পাঁচটি অ্যাডজাস্ট ফ্যান বন্ধ করে সবাইকে আমার কাছে আসতে বলি। আগুন নেভানোর সিলিন্ডার দিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করি। পরে জেনারেল ম্যানেজার (মহাব্যবস্থাপক)-এর কক্ষের জানালা ভেঙে বাঁশ ধরে তিনজন পুরুষ ও ১২ জন মহিলাকে নিচে নামিয়েছি। ভবনের দক্ষিণ পাশে আগুন না ছড়ানোয় আমি, আমার স্ত্রী ও বাকিরা নামতে পেরেছি।
চুরির ভয়ে পোশাক কারখানায় আগুন লাগলেই তালা মেরে দেয় মালিকরা
পোশাক কারখানায় তালা লাগানোর অভিযোগ বহু পুরোনো। ২০০৬ সালে কেটিএস টেক্সটাইল অ্যান্ড গার্মেন্টসে আগুনের সময় তালা দেওয়ার কথা আদালতে স্বীকার করেছিলেন এর মালিকরা। কেটিএসে অগ্নিকাণ্ডে নিহত হয়েছিল ৫৪ জন, যার ৪০ জনের লাশ পাওয়া গিয়েছিল ফটকের সামনে।
এই বিষয়ে সম্মিলিত গার্মেন্টস ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা বেগম বলেন, ণ্ণমালিকরা শ্রমিকদের মূল্যায়ন করে না। তাদের দৃষ্টিতে শ্রমিকরা যেন চোর। সেই কারণে কারখানার দরজা, প্রধান ফটক তালাবদ্ধ করে রাখে। আর তাতে আগুন লাগলে শ্রমিকরা অবরুদ্ধ হয়ে মারা যায়। এটা এক ধরনের হত্যাকাণ্ড।’
শিল্প পুলিশের অনুমতি নিয়ে সকাল নয়টায় তাজরীন ফ্যাশনে ঢোকেন জাহিদুল। কান্নাভেজা কণ্ঠে তিনি বলেন, ণ্ণশনিবার রাতে আমি তিন তলায় কাজ করছিলাম। আগুনের খবর পেয়ে পাঁচ তলায় স্ত্রী লাভলী বেগমকে আনার চেষ্টা করি। কিন্তু বাধা দেন আমাদের ম্যানেজার রাজ্জাক। তারপর আমি দক্ষিণ পাশে অ্যাডজাস্ট ফ্যান ভেঙে নির্মাণ কাজের জন্য বেঁধে রাখা বাঁশ বেয়ে নিচে নেমে আসি।’
জাহিদুল বলতে থাকেন, ণ্ণপ্রতিটি তলায় কোলাপসিবল গেটে তালা লাগিয়ে দেন ম্যানেজার রাজ্জাক ও কোয়ালিটি ম্যানেজার দুলাল। তা না হলে ছাদে উঠে অন্তত অনেকে প্রাণ বাঁচাতে পারত। সঙ্গে প্রশ্ন ছোড়েন, আমার সাড়ে চার বছরের ছেলেকে নিয়ে এখন কী করব? আমার স্ত্রীর সঙ্গে তার দুই বোন লাইলী ও পপিকেও খুঁজে পাচ্ছি না।’
স্বতঃস্ফুর্ত শ্রমিক বিক্ষোভ
দেশের প্রায় সাড়ে ৩ হাজার পোশাক কারখানার মধ্যে আশুলিয়াতেই রয়েছে সাড়ে তিনশোর বেশি। বার বার দুর্ঘটনা ঘটলেও যথাযথ ব্যবস্থা না নিয়ে কারখানা মালিকরা শ্রমিকদের ণ্ণহত্যা করছে’ এমন অভিযোগে ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়ক অবরোধ করে প্রায় তিন ঘণ্টা বিক্ষোভ করেছে কয়েক হাজার পোশাক-শ্রমিক। আশুলিয়া শিল্প পুলিশের উপ-পরিচালক মোক্তার হোসেন জানান, বিশৃঙ্খখলার আশঙ্কায় নরসিংহপুর, নিশ্চিন্তপুর, বেরন, ঘোষবাগ, বাইপাইল ও পলাশবাড়ি এলাকার সব কারখানায় ছুটি ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ।
আশুলিয়া শিল্প পুলিশের পরিচালক আবদুর রউফ জানান, জামগড়া এলাকার বেশ কিছু কারখানার শ্রমিক গতকাল সকালে নিজেদের কারখানায় গিয়ে নিহত শ্রমিকদের প্রতি শোক পালনের জন্য ছুটি চায়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাতে রাজি না হওয়ায় অগ্নিকাণ্ড ও হতাহতের জন্য গার্মেন্টস মালিকদের দায়ী করে বিক্ষোভ শুরু করে তারা। ফলে ওই এলাকার কয়েকটি কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়। এরপর কয়েক হাজার শ্রমিক দল বেঁধে তাজরীন ফ্যাশনের পোড়া কারখানার সামনে গিয়ে বিক্ষোভ দেখাতে থাকে। এক পর্যায়ে শ্রমিকরা সেখানে অবস্থানরত পুলিশের ওপর ঢিল ছুঁড়তে শুরু করলে পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়। পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কায় আশুলিয়ার সব কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয় বলে শিল্প পুলিশের আবদুর রউফ জানান। তাজরীন ফ্যাশনস থেকে সরে গিয়ে কয়েক হাজার শ্রমিক জড়ো হয় নরসিংহপুর-জামগড়া এলাকায় ঢাকা টাঙ্গাইল সড়কে। তারা সেখানে বিক্ষোভ শুরু করলে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ঘণ্টা তিনেক বিক্ষোভের পর পুলিশ সড়ক থেকে তাদের সরিয়ে দিলে বেলা ১টার দিকে আবার যান চলাচল শুরু হয় বলে শিল্প পুলিশের উপ-পরিচালক মোক্তার হোসেন জানান।
Leave a Reply