অমিতাভ মিত্র, শান্তিপুর, নদীয়া, ২০ জুন,#
চা-এর আসর বন্ধ হচ্ছে খবরটা অনেকদিন ধরেই শুনছিলাম। আজকাল প্রত্যুষদা আর প্রদ্যুৎদার শরীরটাও তেমন ভাল যাচ্ছিল না। একার পক্ষে দুজনার কারোর-ই একটানা চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। কিন্তু আচমকা যে সেদিনই বন্ধ হয়ে যাবে ভাবিনি। বিশেষ একটা কাজে কলকাতায় ছিলাম, বিকেলে পার্থবুড়োর ফোন — ‘চায়ের আসর বন্ধ হয়ে গেলো। আজ শেষবারের মতো সকলে চা খেয়ে গেল।’ বলেই আমাকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কট্ করে ফোনটা কেটে দিল। পার্থ বুড়ো মানে আমার পার্থ-দা এমনই। কোনো কিছুতে ব্যথা পেলে বা আবেগকে আঘাত করলে পার্থ-দা সেটা নিয়ে অনেকক্ষণ ভাবে। মনে পড়লো কয়েক মাস আগে বিকেলের কথাটাকে। তখন শান্তিপুর নিয়ে তথ্যচিত্রের কাজটা খুব মন দিয়ে করার চেষ্টা করছি, পার্থদার সাথে মতিগঞ্জে দেখা। বলল, ‘আমার একটা কাজে হাত দিবি, শান্তিপুর-এর চায়ের আসর নিয়ে একটা কাজ করবি?’
তাৎক্ষনিকভাবে পার্থদাকে সম্মতিও দিয়েছিলাম। শুধু তাই নয় এ ব্যাপারে বিভিন্ন জনার সঙ্গে দেখাও করতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু কাজটা আর এগোয়নি। ‘চায়ের আসর’ নিয়ে কাজ করা বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার বলে মনে হয়েছে, তার কারণ শান্তিপুরের ‘চায়ের আসর’ শুধুমাত্র একটা চা-এর দোকানই নয়, একটা প্রতিষ্ঠান। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগষ্ট স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরেই যে দোকানদারটার জন্ম সুদীর্ঘ এত বছর পর ২০১৩-র জুন মাসে তার বন্ধ হয়ে যাওয়া; এর ইতিহাস, এর নস্টালজিয়া, এর আবেগঘন মুহূর্ত স্মৃতিচারীতায় তুলে আনা বড়ই কঠিন কাজ।
১৯৪৭ সালে কালী মুখার্জ্জী মাঠের সামনে তিনু চক্রবর্তীর হাত দিয়ে ‘চায়ের আসর’-এর যাত্রা শুরু। তখন গুড়ের টিনের চারচালা ছিল। দেওয়ালটাও টিনের ছিল। ইঁটের দেওয়াল গাঁথা হয়েছিল ১৯৬৪-৬৫ সালে। এখন যেটা হরদার ‘অঙ্গরাজ’ বা তার পাশের ‘রায় মেডিকেল’ তখন ওখানে নিতাইদার ‘বঙ্গশ্রী’ কেবিন ছিল। বঙ্গশ্রী কেবিন শুরু হয়েছিল বিশ্বেশ্বর মুখার্জ্জীর হাত ধরে। আবার তার পাশেই ছিল তাজ রতনের রেস্টুরেন্ট। অনেক পরে সেই রেস্টুরেন্ট-এর নামকরণ হয়েছিল ‘আমাদের দোকান’। এসব দোকানগুলোতেও কিন্তু চা, পাউরুটি, মাংস, ঘুঘনি সবই পাওয়া যেত। আবার সুশ্রী সিনেমার পাশে এখন যেটা ‘পাল ডেকরেটার্স’, তখন সেটা কাশীনাথ ভট্টাচার্যের চা-এর দোকান ছিল, এসব দোকানগুলোয় মানুষ এসে অর্ডার দিত — খেয়ে চলে-ও যেত। কিন্তু ‘চায়ের আসর’-এ এসে চায়ের কাপেই তুফান তুলত। তাই ‘চায়ের আসর’ অনন্যই ছিল। সেই ‘চায়ের আসর’-এ প্রত্যুষ এবং প্রদ্যুৎবাবুর দাদা গোবিন্দবাবু কর্মী ছিলেন, তার কয়েকবছর বাদে সেই গোবিন্দ বিশ্বাসের হাতে ‘চায়ের আসর’-এর মালিকানা।
এসবই আমার প্রত্যুষদার মুখ থেকে শোনা। তার কারণ ‘চায়ের আসর’-এর যখন জন্ম হয়েছে তার প্রায় ৩০ বছর পরে আমার জন্ম। আমার ছেলেবেলায় আমার বাবাকে, মাঝে মাঝে দেখতাম ‘চায়ের আসর’-এ দাবা খেলতে, একটা চৌকো পারা ঘর, তাতে সার দিয়ে কয়েকটা চেয়ার টেবিল, অনেক লোক বসে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গল্প করছে, কেউ চা-খাচ্ছে, কেউ সিগারেট খাচ্ছে, কেউ বা দাবা খেলছে। বাবার কাছে শুনেছিলাম ওরা নাকি বুদ্ধিজীবী।
তো যাই হোক, ছেলেবেলায় ‘চায়ের আসর’ আমাকে বুদ্ধিজীবিদের ভয় দেখালেও কলেজ পড়ুয়ারা আমাকে কিন্তু সাদরে টেনে নিয়েছিল। কলেজের সামনে রতনদার চা-এর দোকান দুপুরে যেমন টানত, বিকেলে ‘চায়ের আসর’-ও সমানভাবেই আমাকে টানত, একটু আধটু কলেজ-রাজনীতি করতাম, কেরোসিন কিংবা বাসস্ট্যান্ড দিয়ে আন্দোলন টান্দোলনও একটু-আধটু করেছি। আলোচনার জায়গাটাই ছিল ‘চায়ের আসর’-এ। অনেক বিখ্যাত লোকও নাকি এখানে মাঝে মাঝে আসতেন। বিবেক প্রেসিডেন্সিতে পড়ত, খুব বড়াই করে কফি হাউজের কথা বলত। বলত পাগড়ি পরা মানুষেরা নাকি কফি দেয়, আমি তাল ঠুকে বলতাম — ‘রাখ তো তোর কফি হাউজ, তুই তো এখন চায়ের আসর-এই বসে আছিস।’ কলকাতার কফি হাউজ থাকতে পারে, আমিনিয়া থাকতে পারে, আরো অনেক কিছু থাকতে পারে, কিন্তু শান্তিপুরের-ও একটা ‘চায়ের আসর’ আছে, মফস্বলে তুই এমন একটা দোকান দেখা তো সেখানে ছাত্র শিক্ষক একসাথে বসে চা-খাচ্ছে। আমরা যারা বন্ধু মহলে নিজেদের মধ্যে একটু আদিরসাত্মক কথা আলোচনা করতাম সেই আমরাই ‘চায়ের আসর’-এ গিয়েও বসলে বড়দের অত্যন্ত সমীহ করতাম, তখন ‘চায়ের আসর’-এ ডিম, মাংস, ঘুগনি, সবই পাওয়া যেত।
মনে পড়ছে আমাদের ছয় বন্ধুর সেই ঘটনাটা — ছ’জনে মিলে একটা ডিমের মামলেটের অর্ডার দিয়েছিলাম, আবার প্রত্যুষদাকে সেটা ছ-ভাগ করতে বলেছিলাম, যে প্রত্যুষদা এখন আমাকে বুকে জড়িয়ে স্নেহ করেন, তিনিই সেদিন আমাকে ঘুগনি মাখা হাতা হাতে তাড়া করেছিলেন। আরো একটা ঘটনা মনে পড়ে — গল্প করছি বন্ধুরা সামনে রাখা গরম চা, গল্পে মশগুল হয়ে চা খাচ্ছি, হঠাৎ তাকিয়ে দেখি চা-এ পিঁপড়ে বোঝাই। প্রত্যুষদাকে বলতেই প্রত্যুষদা বল — ‘ওগুলো চা-এর পাতা খেয়ে নে।’ এরকম অনেক টুকরো টুকরো ঘটনা মালার মত গাঁথা হয়ে আছে।
‘সুশ্রী’ সিনেমা হল আগেই বন্ধ হয়েছে, ‘সুন্দরশ্রী’টাও ক’দিন আগে বন্ধ হল, এখন ‘চায়ের আসর’টাও বন্ধ হয়ে গেলো। শান্তিপুরের মানুষের মনেহয় আর কিছুই থাকল না। নেট দুনিয়ার জটিলতার আবর্তে সে মানুষগুলো গায়ে গা ঠেকিয়ে গন্ধ নিয়ে বাঁচতে চায়, উড়ো চিঠির হাতছানিতে না ভুলে একে অন্যের সম্পর্ককে বিশ্বাস করে তারা বোধহয় স্মৃতি আঁকড়েই বাতিল হয়ে গ্যালো।
Leave a Reply