সুব্রত পোদ্দার, মেমারি, বর্ধমান, ১৩ মে#
বর্ধমান জেলা যতই ধান চাষে সমৃদ্ধ হোক না কেন, আমাদের ওখানকার ব্যাপক অংশের উপার্জন খুব সামান্য। এরা আদিবাসী মানে সাঁওতাল, এছাড়া আছে দুলে, বাগদি, হাঁড়ি ইত্যাদি সম্প্রদায়। গ্রামের ৫৫-৬০ শতাংশ মানুষ এই তথাকথিত নিচু জাতের মধ্যে রয়েছে। বাকি ৪০-৪৫ শতাংশের মধ্যে যারা লেখাপড়া শিখে একটু উন্নত হয়েছে, তারা গ্রামের বাড়িতে থাকে না। একশো দিনের কর্মপ্রকল্প চালু হওয়ার পর আমাদের পঞ্চায়েত গর্ব করে, গড়ে আমরা সাড়ে চৌত্রিশ দিনের কাজ দিয়েছি। বাস্তব চিত্র কিন্তু পুরোপুরি তা নয়, এটা দেখানো হয়। আমাদের ওখানে সব তিনফসলি জমি। তিনটে সিজনে এই মানুষেরা কাজ করে। তাদের নিজস্ব জমি কিছু নেই। কেউ কেউ বর্গায় দু-চার ছটাক পেয়েছে। ও দিয়ে পেট চলে না। তিনখানা সিজনে — রোয়া এবং কাটা মিলে — দশ দশ কুড়িদিন করে কাজ, অবশ্য যে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে পারবে তার। তাহলে বছরে মোট ষাটদিন মাঠের কাজ আর চৌত্রিশ দিন একশো দিনের প্রকল্পে, সারা বছরে মোট চুরানব্বই দিনের কাজ, সেটা না হয় বাড়িয়ে একশো ধরা হল। একশো দিনের প্রকল্পে রেট ১৫১ টাকা, চৌত্রিশ দিনের জন্য আর বাকি ছেষট্টি দিনের মাঠের কাজে রেট ১৩০ টাকা। একশো দিনের কাজে পরিবার পিছু একটাই জবকার্ড। তাহলে সারা বছরের আয় দাঁড়াচ্ছে ১৩,৭১৪ টাকা। আমরা যখন ২০০৩ সালের শেষের দিকে কাজটা শুরু করেছিলাম, তখন ছবিটা এর থেকেও খারাপ ছিল। একটা পরিবারের সদস্য কমপক্ষে চারজন, বেশি হলে ছ-সাতজনও হতে পারে। ৩৬৫ দিনই খেতে হবে, হিসেব মতো দৈনিক আয় দাঁড়ায় ৩৭ টাকা ৫৭ পয়সা। আয়টা বাস্তবে আর একটু বেশিই হয়। কারণ এই লেবার শ্রেণীর ঘরে স্বামী স্ত্রী দুজনেই খাটতে যায়। একশো দিনের কাজ দুজনে না পেলেও মাঠের কাজ পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু এই আয়ে কীভাবে খাওয়া চলবে?
আমরা দেখেছি, তারা সজনে পাতা সেদ্ধ করে খায়। সাঁওতাল মানুষের খাদ্যাভাসে ডাল নেই। ডাল যখন সস্তা ছিল, তখনও ওদের ঘরে ডাল ঢুকত না। কখনো-সখনো মাছ চুরি করে আনলে মাছ পড়বে পাতে। অন্যান্য সবজি বাজার থেকে কেনার প্রশ্নই নেই। বনে-বাদাড়ে কুড়িয়ে বা চুরি করে যেটুকু মেলে সবজি খাওয়া সেটুকুই। এইরকম অবস্থায় দাঁড়িয়ে আমার ভাইয়ের বন্ধু, আমার বন্ধু যেসব সাঁওতাল ছেলেপিলে বলত, তুই টাউনে আছিস, এখানে চলে আয়, একটা কিছু সবাই মিলে করি, মানুষজন খেতে পাচ্ছে না। ঘটনাচক্রে আমার দুই ভাই মারা গেছে, ফলে আমার বাবা-মায়ের কাছে থাকার দরকারও হয়ে পড়েছিল। এরাও ডাকছিল। আমি গ্রামে ফিরে গেলাম। কয়েকমাস ধরে পাড়ায় পাড়ায় গ্রামে গ্রামে আলোচনা করেছি, কী করা যায়? তারপর একটা গ্রুপ তৈরি করে বিডিও অফিসে, পঞ্চায়েতে বারবার গেলাম। আমরা বারবার চেষ্টা করেছি কো-অপারেটিভ আইনে আমাদের সংস্থাকে রেজিস্ট্রিভুক্ত করতে। তাহলে আমরা সরকারের কাছ থেকে কিছু কাজকর্ম পাব। কিছু মানুষের কর্মসংস্থান করতে পারব। তিন ধরনের বাই-লজ কলকাতা থেকে কিনে নিয়ে গেছি। আড়াই বছর ঘুরে সিআই সাহেব শুভ্রজ্যোতি বাবু বললেন, ণ্ণভাই তুমি ভুল বুঝো না। তোমরা যেভাবে পারো কিছু করো। কিন্তু আমি কো-অপারেটিভ রেজিস্ট্রেশন করিয়ে দিতে পারছি না।’ তিনি চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কারণটা ছিল অন্য কিছু।
এরপর আমরা কো-অপারেটিভ সোসাইটিগুলোতে ভিজিট করতে শুরু করি। সকলেই ণ্ণশ্রীধরপুর কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক’-এর কথা জানে। এশিয়ার মধ্যে প্রথম সারির কো-অপারেটিভের মর্যাদা পেয়েছিল। এখন অবশ্য তেমন গ্রোথ নেই। যা অ্যাসেট আছে তাতে চলে যাচ্ছে। আমাদের গ্রাম থেকে তিন কিলোমিটার দূরে এই কো-অপারেটিভ। এসব জায়গায় ভিজিট করলাম। বর্ধমান সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান চিত্তরঞ্জনবাবুর কাছেও পৌঁছেছিলাম। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, কীভাবে আপনাদের এই কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের ফর্মেশনটা হয়েছিল? উনি বললেন, ণ্ণতখনকার দিনে তো সেলফ হেল্প গ্রুপ ছিল না। কিন্তু ওইধরনের গ্রুপ করেছিলাম। তারপর যখন আইন হল, আইনি স্বীকৃতি পেয়ে গেলাম।’
আমাদের শিক্ষা নিকেতন চলছিল ২০০৪ সাল থেকে। কম্পিউটার এডুকেশন শুরু হল ২০০৫ সালে। তারপর কম্পিউটার সারাই করা, বানানো শিখলাম। এইসব করতে করতে যখন দেখলাম, সবই করছি, কিন্তু পুঁজি না হলে দাঁড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। ব্যাঙ্কের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে ফিরে এসেছি। কো-ল্যাটারাল সিকিউরিটি ছাড়া কোনো গভর্নমেন্ট প্রজেক্টে ব্যাঙ্ক ফিনান্স করেনি। আমরা আমদের সমস্ত সার্টিফিকেট জমা রাখতে চেয়েছিলাম ব্যাঙ্কের কাছে। কিন্তু সেগুলোর কোনো মূল্যই ওদের কাছে ছিল না। আমাদের পরিষ্কার বলে দেওয়া হয়েছিল, ব্যাঙ্ক টাকা দিয়ে টাকার ব্যবসা করতে বসেছে। তোমরা সমাজসেবা করোগা। ততদিনে আমাদের সঙ্গে যারা জড়ো হয়েছিল, অনেকে ছেড়ে চলে গেল।
এবার আমরা আমাদের সদস্যদের মধ্যে আলোচনা করে ডিপোজিট রাখতে শুরু করলাম। নিজেরাই সঞ্চয় করা শুরু করে ফান্ড তৈরি করেছি। সেই টাকা খাটিয়ে কম্পিউটার ব্যবসাটাকে বাড়িয়েছি। কম্পিউটার এডুকেশনে কম্পিউটারের সংখ্যা বাড়িয়েছি, যাতে স্টুডেন্ট পিছু একটা করে কম্পিউটার দিতে পারি। এইবার লোকে বলেছে, তোমরা এই ক-টা লোকের মধ্যে টাকা নিচ্ছ, আমাদের সঞ্চয় করার সুযোগ দেবে না কেন? এইভাবে সদস্য সংখ্যা বাড়তে বাড়তে আজকে তা সাত হাজারের ওপরে চলে গেছে।
সঞ্চয়কারী ১ টাকা করে দৈনিক জমা রাখলে ৩৬৫ দিনে ৩৬৫ টাকার ওপর ৯.০২\% সুদের হিসেবে পাবে ৩৮০ টাকা, ১০ টাকা করে জমা রাখলে ৩৮৮০ টাকা। তার বাড়িতে প্রত্যেকদিন একজন কর্মী সাইকেলে করে গিয়ে সংগ্রহ করে নিয়ে আসবে। প্রথমে আমাদের ছিল ৯.০২\%, যখন তথাকথিত চিট ফান্ডের রমরমা শুরু হল, আমাদের ১\% বাড়াতে হল। যে কর্মী বাড়ি বাড়ি গিয়ে সংগ্রহ নিয়ে আসে, তাকে আমরা বলি সঞ্চয়-সাথি। তাকে দিতে হয় ৩\%। আমাদের কালেকশন কম, তাই আমাদের গড় অফিস-সংক্রান্ত খরচ বেশি। বিল্ডিং ভাড়া, ইলেকট্রিসিটি, অফিস-স্টাফদের বেতন সব নিয়ে ৫\%। ১৬-১৮\% আমাদের মোট খরচ। এই খরচ করেও আমরা মানুষকে রিটার্ন দিতে পারছি, কিন্তু ব্যবসা যখন খারাপ থাকে, তখন দম বেড়িয়ে যায়। আমরা কাউকে ঘুষ দিই না। রাজনৈতিক চাঁদা মানে পঞ্চাশ টাকা, যেই আসুক।
২০০৮ সালে আমাদের রানিং ডিপোজিটর ৩০০০ ছিল। ২০০৯ সালে ৪০০০ হয়ে গিয়েছিল। দেড় বছর আগে আমাদের ডিপোজিটরের সংখ্যা কমে হয়েছে ছশো। এটা এমনি এমনি হয়নি। আমাদের ২২ জন এজেন্টকে আমরা তাড়াতে বাধ্য হয়েছি। তারা আমাদের সাতগাছিয়া বাজারের মধ্যে ১৫টা বিভিন্ন কোম্পানির অফিস নিজেদের উদ্যোগে খুলিয়েছে। আমাদের কাছে আয় ওদের ৫-৭ হাজার টাকা আর ওইসব কোম্পানিতে আয় করতে পারবে ৩৩-৩৫ হাজার টাকা। আপনি একজন সদস্য, আপনাকে ওরা বোঝাচ্ছে, বসুন্ধরা কী দিচ্ছে? ৯.০২\%। আমরা দেব ২৫\%, ৩০\%। তুমি চলো, তোমার টাকার রিস্ক আমার। ডিপোজিটরের সংখ্যা মারাত্মক কমে যাওয়া হয়েছে ওই প্রলোভনের ফলে। আমরা তাদের ধরে রাখতে পারিনি। একমাত্র যে মানুষগুলো আশির দশকে ছ্যাঁক খেয়েছে, ঘরপোড়া গরু, তারা বেশি ইন্টারেস্টের লোভে যায়নি।
সাতগাছিয়া বাজারকে কেন্দ্র করে ৪-৫ কিমির মধ্যে আমাদের ডিপোজিটর রয়েছে। ৩৬৫ দিনই যাতে সঞ্চয়-সাথি তার কাছে সাইকেলে পৌঁছাতে পারে। এটা সম্ভব না হলে আমরা দরখাস্তটা মঞ্জুর করি না। বর্তমানে আমরা দিন প্রতি কালেকশন পাই ১৩,৫০০ টাকা। প্রতিদিন ১০০ টাকা জমা দেওয়ার লোক ৩০-৪০ জন আছে। এর থেকে বেশি জমা পড়ে না। ১-২-৫-১০ টাকার কালেকশনই বেশি। আমাদের ডিপোজিটরদের ছ-মাস পর ৭৫-৯০\% লোনের ব্যবস্থা আছে। সুদের হার মাসিক ১টাকা ১০ পয়সা। বছরের মাঝখানে টাকা ফেরত দেওয়া হয় না।
আমরা কম্পিউটারের কোনো স্টক রাখি না। একটা শো-রুম সাজাতে যে ক-টা মেশিন লাগে, সে ক-টা সাজানো আছে। সেটা বেরিয়ে গেলে আমার সঙ্গে সঙ্গে কলকাতায় অর্ডার হবে। পরদিনই ট্রান্সপোর্টে মাল নামিয়ে দেবে আমার কাছে। আমাকে অর্ডার দিলেই আমি মাল তুলব। বর্ধমান, নদিয়া, হুগলি, এই তিন জেলায় বেশিরভাগ পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি, বিডিও অফিস, স্বাস্থ্য দপ্তরে যত কম্পিউটার সাপ্লাই এবং সার্ভিস আমরা করি। এগুলো টেন্ডার দিয়ে পেতে হয়। সব ক্ষেত্রে পাইও না। সব জায়গায় নিয়ম মেনে টেন্ডার হয় না। আমাদের চেষ্টা থাকে, কম প্রফিট করে আমরা টেন্ডারটাকে ধরব। টোটালের ওপর সেলটা বেশি হলে পুষিয়ে যায়। সার্ভিসটাও আমরা ভালোভাবে করি। এই কাজে আমাদের স্টুডেন্টদের আমরা ৪০০০ টাকা মাইনে দিয়ে পেয়ে যাই। একটা ছেলে সারা দিনে ১৫০-২০০ কিমি মোটরসাইকেলে রান করে। পিছনে বাঁধা থাকে ডাই করা কম্পিউটার, সরঞ্জাম ইত্যাদির বোঝা। ঘুষ দিই না বলে, আমাদের চেক ইচ্ছাকৃত আটকে রাখা হয়েছে।
Leave a Reply