দীনবন্ধু বিশ্বাস, শান্তিপুর, নদীয়া, ২৯ জুন#
দীর্ঘ দাবদাহের পর জুনের শেষে বর্ষা এল। হাসফাসানি গরম গেল। স্বস্তি এল শহরে। কিন্তু বর্ষাসুন্দরী গ্রামের হাজা মানুষের জীবনে কী ভয়ঙ্কর বার্তা নিয়ে এল, আমরা কি তার খবর রাখি? খুঁজে দেখি কি নদীকেন্দ্রিক বাংলার গাঁয়ে গাঁয়ে, শহর থেকে বেড়িয়ে আসা ড্রেনের মুখে মুখে কতশত হরিজন পাড়ার নিরীহ মানুষের স্বপ্ন ভেসে যায় জলের তোড়ে?
শান্তিপুর বিধানসভার ২২ নং ওয়ার্ডের নবীন পল্লীর বাসিন্দা সৌমেন বিশ্বাসের তিন পুরুষের বসত বাড়ি ধসে গেল দু’দিনের বর্ষার দাপটে। এতে অবশ্য বৃষ্টির দোষ নেই, দোষ পরিকল্পনাহীন ড্রেন নির্মানের। ২৪টি ওয়ার্ড নিয়ে শান্তিপুর পৌরসভা। এর সঙ্গে আছে হরিপুর পঞ্চায়েত। এই বিস্তীর্ণ এলাকার জল নিষ্কাশনের জন্য পৌর কর্তৃপক্ষ ১৯, ২০, ২১, ২২ নং ওয়ার্ডের বুকের উপর দিয়ে প্রায় এক কিমি লম্বা ড্রেন তৈরি করেছে। যার পরিকল্পনা হাইড্রেনের মত হওয়া দরকার ছিল। ড্রেনের প্রান্তভাগ অবশ্যই হরিপুরের বড়ো বিল অথবা গঙ্গাবক্ষে সংযুক্ত করতে হত। কিন্তু তা না করে ড্রেনের মাথা নবীন পল্লীর মধ্যপাড়ার বসতির মধ্যেই শেষ করেছে শান্তিপুর পৌর কর্তৃপক্ষ।
এটা হয়তো অবৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা, যদিও বাসিন্দাদের অভিযোগ, রাজনৈতিক দলাদলির জঘন্যতার স্বরূপ এই ড্রেন। ২২ নং ওয়ার্ডের ১৫৪ নং বুথে রুলিং পার্টির পর্যাপ্ত ভোট ছিল না বলেই ওই ড্রেন এই পর্যন্ত এসে থেমে গেছে। জনপ্রতিনিধি ও পৌরসভাতে গিয়ে গ্রামের লোক দলেদলে অভিযোগ অনুযোগ করলেও ড্রেন বর্ধিত করে বিল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যায়নি। এমনকি শহরের বুকের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ড্রেনের তলদেশ ঢালাই করে বাঁধানো হলেও, গ্রামের গরীব শ্রেণির পাশ দিয়ে ঠেলে আসা ড্রেনের তলা কাঁচা থেকে গেছে। ফলে জলের তোড়ে তা সহজেই গোড়া থেকে উপড়েছে। ধনী-গরীবের এই বৈষম্য কমল না। দল পালটায়, রঙ পালটায়, শোষণ বদলায় না।
আজও ভাঙা বাড়ির পাশে দাঁড়ালে শুনবেন এক চিলতে ভিটের ধারে বসে সোমেনের বৃদ্ধ মায়ের নিরন্তর কান্নার ধ্বনি। ওই কান্নার মাঝে গ্রাম্য-মহিলার মৌলিক প্রশ্ন — ণ্ণশহরের গু-মুত ধুয়া-মুচা জল দিয়ে এমন ভাবেই মারবি যদি, একুন একেবারে আমারে মারে দে। আমরা তো তোদেরই ভোট দিচি, একতা কতভাবে বিশ্বাস করাব।’
আরও দেখতে পাবেন, এই বাড়ির ছোট্ট ছেলেটা জলের তোড়ের দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কারণ মেলা থেকে কেনা দশ টাকার খেলনা সহ মায়ের কাপড়ের বাক্সটা যে জলের তোড়ে ভেসে গেছে। ওদের মাথা গোঁজার স্থান নেই। দলেদলে কিছু নেতা নেত্রী আসছে আর যাচ্ছে। সব্বাই ভবিষ্যৎ কালের বাক্য বলছে — হবে, দেখব, কবে ইত্যাদি ইত্যাদি। ওদের জীবনে বর্তমান আসবে কবে? বৃদ্ধ মা আকাশের দিকে তাকায় আর চোখ মোছে, কারণ আর একবার ঢল নামলেই বাকি ভিটেটুকুর আর চিহ্ন থাকবে না। একটা গোটা পরিবারের জীবনের স্বপ্ন ভেসে যাবে জলে। ওরা তখন উদ্বাস্তু। এই কি আমাদের প্রত্যাশার বর্ষা!
Leave a Reply