সন্মথ নাথ ঘোষ, বঙ্কিম, জিতেন নন্দী, ২৭ সেপ্টেম্বর। ছবি প্রতিবেদকদের#
পঞ্জিকার পাতায় লেখা আছে, এবার দেবী দুর্গার গজে আগমন। ফল, শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা। কিন্তু গ্রামবাংলার বহু অঞ্চলে এবছর বর্ষায় মার খেল চাষ ও চাষিসমাজ। বাজারে সবজির আগুনদরে তা আমরা সকলেই টের পাচ্ছি। এইরকম এক সর্বনাশা পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে আজ আমরা গিয়েছিলাম খারোর বিলে। হাবরা পুরসভার নগরথুবা অঞ্চলের বদরতলা গ্রামের কোলেই এই বিল। চারদিকে কেবল জল আর জল। কে বলবে যে এখানে ছিল ভরা ফসলের খেত। ওখান থেকে চাষিদের নৌকায় চেপে আমরা বিলের জলে ঘুরে দেখতে বেরোলাম। এটা হল নাঙলা বিলের একটা শাখা। পূর্ববঙ্গ থেকে দফায় দফায় নমঃশূদ্র পরিবারের মানুষ এসে এখানে চাষআবাদ শুরু করেছে।
শ্রাবণ মাসের গোড়ায় দুদিন টানা বৃষ্টিতে খারোর বিল ডুবে যায়। ২০০০ সালের পর এই প্রথম এত ভয়াবহ অবস্থা হয়েছে। পশ্চিম থেকে পূর্বে স্রোতের মতো হাবড়ার জল এসেছে পুরোনো পদ্মার খাত ধরে। একদিকে হাবরা পুরসভার পাশ দিয়ে আর একদিকে জয়গাছি শ্রীনগর গেট হয়ে জল ঢুকে পড়েছে বিলে। পাঁচ-সাত ফুট উঁচু জল।
চাষিদের মধ্যে সুশান্ত মজুমদার বলেন, আমি নিজে দু-আড়াই বিঘেতে বাগদা কলা (এক জাতের কাঁঠালী কলা) আর পাঁচ বিঘেতে আখ লাগিয়েছিলাম। খরচ পড়ে বিঘে প্রতি বিশ হাজার টাকা। এই বৈশাখের আগের বৈশাখে কলা লাগিয়েছিলাম। ১৮ মাসের মাথায় ফল আসার কথা। আমন ধানও লাগিয়েছিলাম সবে। পাট লাগানো ছিল। দুদিনে জল ঢুকে নিমেষে সব নষ্ট করে দিল।
অনিল সরদার বলেন, গেল ফাল্গুন মাসে দুই বিঘা জমিতে আউশ লাগিয়েছিলাম। পাকা ধান ডুবে গেছে। আট বিঘায় পাট ছিল। তোলবার সুযোগটাও দেয়নি। বিমল হালদার বলেন, আমার আখ ছিল উঁচু জায়গায়। নিজস্ব আর ভাগে মোট পাঁচ বিঘায় ধান লাগিয়েছিলাম। ঘরের গোবিন্দভোগ বীজ করা ছিল, বাকিটা রঞ্জিৎ বীজ বাজার থেকে কিনেছিলাম। একদম সব জলের তলায়।
আক্রমপুরের সমীর সাহা বলেন, আমি মাঠে ৫-৬ বিঘায় আখ লাগিয়েছিলাম। আমার আংশিক ক্ষতি হয়েছে। বিমল হালদারের ভাই গৌরাঙ্গ হালদার সবজি লাগিয়েছিলেন — উচ্ছে, পুঁইশাক, মানকচু, বরবটি, চালকুমড়ো — ৭-৮ বিঘায়। ধান লাগিয়েছিলেন সাত বিঘায়। পুরোটাই নষ্ট হয়েছে।
আমরা যে এলাকাটায় নৌকায় গেলাম, সেটা গোয়ালবাটি মৌজা। এর মধ্যে রয়েছে প্রায় ৩৫০-৪০০ বিঘা চাষের জমি; পাশেই আক্রমপুর মৌজায় রয়েছে আরও সাড়ে তিনশ বিঘা, সেটা তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যারা নিচেরদিকে বাস করে, এমন ২০-৩০ ঘরে জল উঠে এসেছে। তাদের ইস্কুলবাড়ির শিবিরে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।
জল থেকে উঠে আমরা বদরতলায় সঞ্জয় রায়ের বাড়িতে বসে কথা বলি। এই গ্রামে ১৩০-১৩৫ ঘর, কমবেশি সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে চাষ করে মূলত এক-তৃতীয়াংশ পরিবার। যারা জনমজুর খাটে, তারা মাঠে আর কাজ পাচ্ছে না, অন্য কাজে বাইরে চলে যাচ্ছে। হাবরা পুরসভার ২৩টা ওয়ার্ডের মধ্যে ১০টা কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ৫টার অবস্থা সঙ্গীন। এখানে প্রায় সবাই নিজের জমির পাশাপাশি জমি লিজ নিয়ে (বিঘা প্রতি বছরে ৩ থেকে ৮ হাজার টাকা মূল্য), স্টেট ব্যাঙ্কের লোন নিয়ে চাষ করেছে। একে ফসল মার খেল, তায় মাথায় দেনার বোঝা চেপে গেল।
সঞ্জয় রায়ের চাষি পরিবার। কিন্তু তার ঘরের সামনে দাওয়ায় তিনটে সেলাই মেশিনে স্কুলব্যাগ সেলাইয়ের কাজ হচ্ছে। গ্রামের ছেলেরাই ফুরনে কাজ করে। যে দিনকাল পড়েছে, তাতে শুধু চাষ করে আর সংসার টানা যাচ্ছে না। সবাই কিছু-না-কিছু দ্বিতীয় রোজগারের ধান্দা করছে। চাষ আর লাভজনক নয়।
Leave a Reply