২৮ মে, সুব্রত দাস, বদরতলা, মেটিয়াব্রুজ#
আমার সাহিত্যিক তথা সাংবাদিক দাদা পঙ্কজ নাথ একদিন দুপুরবেলা ফোন করে আমাকে বর্ধমানের পাটুলির জামালপুর গ্রামের বুদ্ধপূর্ণিমার মেলা দেখতে যাওয়ার অনুরোধ জানালেন। আমি রাজি হয়ে গেলাম। যথারীতি ২৪ মে শুক্রবার আমি পৌঁছে গেলাম হাওড়া স্টেশনের বড়ো ঘড়ির তলায় দুপুর তিনটে বাজতে পাঁচ মিনিট আগে। পঙ্কজদা আগেই পৌঁছে গেছেন। ওঁর সঙ্গে ছিলেন ওই গ্রামের বাসিন্দা দুর্লভবাবু, তাঁর দোকানের দুজন কর্মচারী এবং একজন প্রাবন্ধিক রীতেশ দেব। পরিচয় পর্ব সেরে নেওয়া হল। টিকিট আগেই কাটা হয়ে গিয়েছিল। আমরা সকলে ট্রেন ধরলাম। তিনটে পনেরো মিনিটে ট্রেন ছাড়ল। আমরা নবদ্বীপ স্টেশনে নামলাম সাড়ে পাঁচটা নাগাদ। ওখানেই সন্ধ্যা ছ–টায় আবার উঠলাম কাটোয়া লোকালে। সাড়ে ছ–টায় পৌঁছালাম পাটুলি স্টেশনে।
দুর্লভবাবুর নেতৃত্বে আমরা যাচ্ছি ওঁরই গ্রামের বাড়িতে। সকলে একটা মোটরচালিত ভ্যানে চেপে বসলাম। ভ্যানওয়ালা জানালেন, ‘বাবু, ভ্যান জামালপুর পর্যন্ত যাবে না, নিমদহ ঘোষপাড়ার মোড়ে নেমে যেতে হবে।’ দুর্লভবাবুও তাতে সায় দিলেন, ‘কিছু করার নেই, রাস্তায় এত ভিড় যে ওর পর যাওয়ার পারমিশন প্রশাসন দেয় না।’ নিমদহ ঘোষপাড়া পাটুলি স্টেশন থেকে সাত কিলোমিটার। স্টেশন রোড পার হয়ে বেশ কিছুটা যাওয়ার পর চোখে পড়ল, বেশ কয়েকটা দল চলেছে, তাদের পরনে লাল রঙের পোশাক। সকলের হাতে তরোয়াল, খাঁড়া, টাঙ্গি, তাসার মতো বাজনাম সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা ভেড়া/ছাগল। অনেকটা আমাদের মেটিয়াব্রুজে মহরমের সময় যেমন ‘হায় হুসেন, হায় হুসেন’ বলতে বলতে মানুষ ছোটে, সেরকম ছোটো ছোটো কুড়ি–পঁচিশজনের দল। দুর্লভবাবু জানালেন, ‘এরা সব মন্দিরে যাচ্ছে’। প্রায় চল্লিশ মিনিট পর ভ্যান নমদহে পৌঁছাল। ওখানে দেখি, আমাদের মেটিয়াব্রুজের মতোই বাঁশের ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছে রাস্তার ওপর। গ্রামের রাস্তার চৌমাথায় খাঁকি উর্দিধারী পুলিশ বসে রয়েছে। আমরা সেখানে থেমে চা খেলাম। তারপর ওইসব দলের পিছন পিছন আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। রাস্তায় আলো নেই। ওইদিন দুপুরের দিকে বৃষ্টি হয়েছে। পিচ রাস্তা হওয়া সত্ত্বেও প্যাচপ্যাচে কাদা মাড়িয়ে আমরা এগোলাম। আমরা একদিকে এগোচ্ছি আর অন্যদিকে আর একদল লোক পুজো দিয়ে ফিরছে। মোড়ে মোড়ে আলো এবং বিনামূল্যে ঠান্ডা জলের ব্যবস্থা করেছিল বেশ কয়েকটা রাজনৈতিক সংগঠন। জনসমুদ্র ঠেলে চার কিলোমিটার রাস্তা দেড় ঘণ্টায় অতিক্রম করে আমরা দুর্লভবাবুব বাড়িতে পৌঁছালাম। মাঠের পাশেই ওঁদের দোতলা বাড়ি। সেই বাড়ির দোতলার একটা ঘর আমাদের থাকার জন্য খুলে দেওয়া হল। জানলা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি, হাজার হাজার ভক্ত চলেছে মন্দিরের উদ্দেশ্যে।
আমরা তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম মন্দিরের উদ্দেশ্যে। দুর্লভবাবুর বাবা বরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিখ্যাত কবাডি কোচ, আমাদের সঙ্গে পরিচয়ের পর বললেন, ‘আমি মন্দিরে যাচ্ছি, আপনারা আমার সঙ্গে চলুন। আমি সমস্ত কিছু ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেব।’ রাস্তায় নেমে দেখি, অবাক কাণ্ড! এক–একটা দলের সঙ্গে টাঙ্গি, খাঁড়া, বল্লম, তীর–ধনুক, তরোয়াল তো রয়েইছে, হাতে বাঁধা বোম রয়েছে। এমনকী অনেক দলে ওয়ান–শটার, পাইপগান পর্যন্ত রয়েছে। তারা নাচতে নাচতে ‘জয়বাবা বুড়োরাজ’ বলতে বলতে মন্দিরের দিকে এগিয়ে চলেছে। কাদা প্যাচপ্যাচে মাঠের ওপর দিয়ে হেঁটে আমরা মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করলাম। মন্দিরের ওপর একচালা খড়ের ছাউনি। কিন্তু দেওয়াল আর মেঝে মোজাইক টালি দিয়ে বাঁধানো। তবে শিবলিঙ্গের চারপাশে তিন মিটার বাই দু–মিটার সম্পূর্ণ মাটির। ওই সমতল মাটির ভিতর প্রায় এক ফুট গভীরে এবং মাটি থেকে দু–ইঞ্চি ওপরে উঠে রয়েছে। মাটির অংশটা লোহার গ্রিল দিয়ে ঘেরা। গ্রিলের ভিতরে দুজন সেবাইত রয়েছে। আগত ভক্তরা গ্রিলের ওপর দিয়ে বাবার মাথায় জল ঢালছে। বরুণবাবু তাঁর আত্মীয় সেবাইত নিমাই বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। তাঁর কাছ থেকে আমরা এই পুজো সম্বন্ধে কিছু জানতে পারলাম।
কথিত আছে, আজ থেকে প্রায় চার–পাঁচশো বছর আগে যদু ঘোষ নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে একটা গরু ছিল। গরুর বাছুর থাকা সত্ত্বেও সে এক ফোঁটা দুধ দিত না। কিন্তু প্রতিদিন নিয়ম করে বাড়ি থেকে চড়তে বেরিয়ে পড়ত। যখন বাড়ি ফিরত, দেখা যেত তার বাঁট ফাঁকা। গৃহ–মালিক একদিন ওই গরুর পিছু নেন। পিছন পিছন এসে লক্ষ্য করেন যে গরুটা জঙ্গলের মধ্যে এই জায়গায় এসে দাঁড়াতেই আপনাআপনি তার বাঁট দিয়ে দুধ পড়ে। যদু ঘোষ ঘটনাটা পূর্বস্থলীর জমিদার মধুসূদন চট্টোপাধ্যায়কে জানান। এরকম দু–তিনদিন লক্ষ্য করার পর গ্রামের কিছু মানুষজনকে নিয়ে ওই জমিদার জায়গাটাতে আসেন। সেখানে হাতখানেক মাটি খোঁড়ার পর এই শিবলিঙ্গ আবিষ্কার করেন। আর যেদিন এই শিবলিঙ্গ সকলের সামনে প্রকাশ পায়, সেদিন ছিল বুদ্ধপূর্ণিমা।
আমরা নিমাইবাবুকে জিজ্ঞাসা করি, শিবপুজোয় তো বলির প্রচলন নেই, তবু এখানে তা হয় কেন? তিনি বলেন, শিবের সঙ্গে এখানে একত্রে রয়েছে মা চণ্ডী। বলি হয় মা চণ্ডীকে উৎসর্গ করে। এখানে তিনদিন ধরে মেলা চলে। সারাবছরে বৈশাখী পূর্ণিমা, জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমা, মাঘি পূর্ণিমা এবং বুদ্ধপূর্ণিমাতে এখানে ভক্ত সমাগম হয়। তবে বুদ্ধপূর্ণিমাতেই সবচেয়ে বেশি ভিড় হয়। যারা এখানে হাতে বেতের লাঠি, গলায় গামছা আর পরনে হাঁটু অবধি ধুতি পরে এসেছে, এরা সন্ন্যাসী। বাবার নামে পাঁচদিন এরা সন্ন্যাস গ্রহণ করেছে।
এরপর ওঠে অস্ত্রধারীদের প্রসঙ্গ। ওই সেবাইত বলেন, এটা অস্ত্র প্রদর্শন নয়। দূর–দূরান্ত থেকে মানুষজন আসছে। নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, উত্তর ২৪ পরগনা, মালদা থেকে মানুষ আসছে। আগেকার দিনে বাইরের মানুষ যখন এখানে বলি দেওয়ার পর মাংস নিয়ে ফিরত, তখন স্থানীয় গরিব মানুষ সেই মাংস ও পুজোর ফলমূল কেড়ে নিত। সেই সূত্রে নিজেদের মালের রক্ষার্থে অস্ত্র নিয়ে আসত লোকে। তাছাড়া, এক গ্রামের সঙ্গে অপর এক গ্রামের বহুদিনের বিবাদের কারণেও পুজো দিতে আসার সময় নিজেদের রক্ষার্থে গ্রামের লোকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসে। প্রশাসন এ নিয়ে কিছু করতে পারেনি।
আমরা মেলা ও মন্দির চত্বর থেকে ফেরার পরে আমাদের আশ্রয়ে ফিরে আসি। শুনলাম, ভোরবেলা মন্দির চত্বরে বহু মানুষ বলি দিতে আসবে। আমরা রাতে শুয়ে পড়ি। কিন্তু বাজনার প্রচণ্ড আওয়াজে ভোর পাঁচটা নাগাদ ঘুম ভেঙে যায়। বেরিয়ে এসে দেখি মন্দির চত্বরে বলিকাঠের সামনে শ–তিনেক ভেড়া–ছাগল জড়ো করা হয়েছে। উৎসাহী মানুষেরা বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে পারছিল না। যে যেখানে দাঁড়িয়ে সেখানেই চার–পাঁচজন মানুষ পশুটাকে ধরে নিজেদের সঙ্গে আনা ধারালো অস্ত্র দিয়েই বলি সাঙ্গ করছিল আর বাবা বুড়োরাজের জয়ধ্বনি দিচ্ছিল। এরপর এল বাঁশের সুসজ্জিত মইতে নৈবেদ্য সাজিয়ে ঘোষবাড়ির লোকেরা, খানিক পরে এল দুটো পালকিতে নৈবেদ্য সাজিয়ে বন্দ্যোপাধ্যায়বাড়ির লোকেরা। পুজোপর্ব মিটতেই দেখি, পাশের একটা মাঠে গিয়ে লোকে জটলা করছে। সেখানে মাটির গামলায় ভাত আর বলির মাংস রান্না হচ্ছে। এক চড়ুইভাতির মতো পরিবেশ। কেউ এসেছে রানাঘাট থেকে, কেউ পলাশি, সালার বা মুরারই থেকে। সদ্য আলাপে আমাদের দুপুরে খাওয়ার আমন্ত্রণ জানাল ওরা। অন্য জায়গায় দেখলাম, অনেকে বলির মাংস ভাগ করে হলুদ মাখিয়ে প্লাস্টিকের প্যাকেটে করে নিয়ে সাইকেলে রওনা দিচ্ছে। আমরাও দুর্লভবাবুর বাড়িতে খাওয়াদাওয়া সেরে ঘরে ফেরার জন্য প্রস্তুত হলাম।
Leave a Reply