১৫ নভেম্বর, অমিতা নন্দী#
মহারাষ্ট্রের বনবাড়িতেন ভরত মানসাটা এবং তাঁর আরও ২৩ জন বন্ধু মিলে মোট ৬০ একর জমি কিনেছিলেন বছর কুড়ি আগে। উদ্দেশ্য ছিল হাতে-কলমে প্রাকৃতিক চাষ করবেন সমবেতভাবে। জাপান থেকে এসেছিলেন প্রাকৃতিক-চাষি মাসানোবু ফুকুওকা। তাঁর অনুপ্রেরণায় মাঠে নেমেছিল ২৪ জন যুবক। বন্ধুরা বেশিরভাগই আর তেমন সক্রিয় থাকেনি। ভরত প্রায় একাই চালিয়ে যাচ্ছেন অন্যান্য কাজকর্মের সাথে সাথে। এ ব্যাপারে ওঁকে সাহায্য করছে এক আদিবাসী পরিবার — বুয়া, তাঁর স্ত্রী এবং তাঁদের ছেলেরা, নিজেদের চাষে কাজের পাশাপাশি। মহারাষ্ট্র ও গুজরাতের এই অঞ্চলে ভক্তি আন্দোলনের প্রেরণায় যারা মদ ও আমিষ খাদ্য বর্জন করে জীবনযাপন করে, তাদের বলা হয় ‘বুয়া’।
ভালসাড়া (গুজরাতের) জেলায় দেহরি গ্রামে ভাস্কর সাভের খেতে প্রাকৃতিক চাষের বিষয়ে আট দিনের এক প্রশিক্ষণ শিবির শেষে আমরা গিয়েছিলাম বনবাড়িতে। মুম্বই-পুনে রেলপথে নেরাল স্টেশন থেকে ১২ কিমি দূরে পাহাড়ি জঙ্গলের মাঝে বনবাড়ি। একই ট্রেনে নেরাল স্টেশনে আমাদের সঙ্গে যোগ দিল আরও দুই দল তরুণ-তরুণী। একটি দলে ছিল নিশা আর সুহাসিনী। আর একটি দলে স্থপতি মাডক সিং এবং ইন্সটিট্যুট অফ আর্কিটেকচারে তাঁর স্থপতিবিদ্যার ছাত্র-ছাত্রী — ধ্রুবাঙ, অনুশ্রী আর প্রিয়াঙ্কা। এদের আগমনের উদ্দেশ্য ছিল বনবাড়িতে মাটি দিয়ে একটি পরিবেশ-বান্ধব ঘর নির্মাণের পরিকল্পনা করা। মাডক ইতিমধ্যেই এই ধরনের বাড়ি তৈরির কাজে মনোনিবেশ করেছেন বেশ কয়েক বছর হল। তাঁর ছাত্র-ছাত্রীরাও কোর্স শেষ করার পর এই ধরনের নির্মাণ কাজে উৎসাহী।
নিশা একজন সমাজ-কর্মী — ফ্রিলান্সার, অসম্ভব কর্মোদ্যমী তরুণী। বনবাড়িতে ও ২০০৪ সাল থেকে অনেকবার এসেছে। গ্রামের সবাই ওকে চেনে। সুহাসিনীর সঙ্গে ওর এক বছরের বন্ধুত্ব। সুহাসিনী মনস্তত্ত্ব নিয়ে পড়াশুনার শেষে একটি এনজিও-র পক্ষ থেকে এক অনাথ আশ্রমে শিশুদের মানসিক শুশ্রূষার কাজ করছে। সারা দেশ থেকে যেসব শিশুরা কাজের আশায় অথবা নানাভাবে মুম্বইয়ে গিয়ে হারিয়ে যায়, তাদের এই আশ্রমে নিয়ে এসে রাখা হয়, যতদিন না তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাড়িতে ফিরিয়ে দেওয়া যায়।
যাই হোক, সেদিন যখন বনবাড়িতে পৌঁছালাম, সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। বনবাড়ি আক্ষরিক অর্থেই ‘বন’-এর বাড়ি। মারাঠি বা গুজরাতিতে ‘বাড়ি’ মানে হল বসতি। থাকার জায়গা হল কয়েকটি গাছের খুঁটির ওপর টালির চালের চারদিক খোলা (কোনো দেওয়াল নেই) এক আস্তানা। উঁচু-নিচু টিলার ঢালের ওপর এক শান্ত তপোবন যেন, খাওয়ার জলের জন্য কিছুটা নিচে এক ইঁদারা, ভারি মিষ্টি তার জল। বৃষ্টির জল জমে তৈরি ছোটো জলাশয় — স্নান এবং অন্যান্য কাজের জন্য। ঘর থেকে কিছুটা দূরে তিন-চারটে অস্থায়ী টয়লেট, কোনোটি শালপাতায় ঘেরা, কোনোটি বা খেজুরপাতায়। কোনো বৈদ্যুতিক সংযোগ নেই। সৌরশক্তির সাহায্যে চলা একটি বড়ো টর্চ দেখলাম বুয়ার হাতে। কয়েকটি মোমবাতি কেনা হয়েছিল স্টেশন থেকে। সবাই মিলে হাত লাগিয়ে কাঠের উনানে ডালপালা জ্বালিয়ে রাতে এবং পরদিন দুপুরেও তৈরি হল খিচুড়ি, তার সঙ্গে স্যালাড। রাতে খাওয়ার পর ওই নিঝঝুম অন্ধকারে বসল গানের আসর। জিতেন একটি লালনগীতি গাওয়ার পর মাডক, নিশা এবং বুয়াও শোনালেন নিজের নিজের ভাষায় গান। এক একজনের গানের অর্থ আর ভাব হিন্দিতে পরস্পরকে বোঝানো হল। সবশেষে ভরত তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী বাঁশিতে শোনালেন এক অপরূপ সুর।
চারদিকে খোলা থাকায় রাতে ওখানে বেশ ঠান্ডা। আমরা যে যার মতো চাদর-কম্বল, কেউ বা স্লিপিং ব্যাগ নিয়ে গিয়েছিলাম। রাতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও প্রত্যেক প্রহরে শোনা যাচ্ছিল মোরগের ডাক। সূর্য ওঠার আগেই ঘুম ভেঙে গেল। আমরা যে যা ফল নিয়ে গিয়েছিলাম — হাতমুখ ধুয়ে প্রথমে সে সব খেয়ে নিলাম। তারপর তুলসি, লেমন গ্রাস এবং অন্যান্য কিছু পাতা আর আদা সহযোগে জলে ফুটিয়ে চা তৈরি হল। এরপর ঘর তৈরির পরিকল্পনা শুরু হল। ভরতের প্রথমে ভাবনা ছিল একটু অন্য জায়গায় থাকার ঘর, স্টোর রুম, রান্নার ঘর, যার কাছাকাছি টয়লেট থাকবে — সবই একই চালের নিচে করার। কিন্তু উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম হিসেব করে এবং জলের সুবিধার কথা মাথায় রেখে ঠিক হল এই চালাটাকেই বাড়িয়ে নিয়ে সব ব্যবস্থা করা হবে। তারপর মাডক ও ধ্রুবাঙ চলে গেল ওদের অন্য একটি প্রজেক্টের কাজে। ওরা আবার কয়দিন বাদে এসে এখানে ঘর তৈরির কাজ করবে।
এরপর নিশা এবং অন্যরা মিলে তৈরি করল জলখাবারের জন্য পোহাল, অনেকটা চিড়ের পোলাওয়ের মতো খেতে। তারপর দল বেঁধে লেগে পড়ল কাছেই এক গোল চত্বরের একটা দিকে সাময়িক আশ্রয়ের জন্য তাঁবু খাটাতে। সেই দলে কারা ছিল? দুজন আর্কিটেক্ট, একজন সাইকোলজিস্ট আর একজন সোশাল অ্যাক্টিভিস্ট, সঙ্গে একটু-আধটু সাহায্য করেছিল আর একজন মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার — হরসিল। এরা সবাই প্রাকৃতিক চাষের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ হয়ে এখানে এসেছে। মইয়ে চড়ে গাছে উঠে এরা তাঁবু খাটাচ্ছে, হেঁইও হেঁইও করে বালতি বালতি জল টেনে আনছে সবার কাজে লাগবে বলে। যারা কোনোদিন কাঠের উনানে রান্না করেনি, তারা চেষ্টা করছে এবং সফলও হচ্ছে খাবার তৈরি করতে। দুপুরে খিচুড়ির সঙ্গে তৈরি হল থাই স্যালাড — কাঁচা পেঁপে কুড়িয়ে তার মধ্যে টমাটো, নুন, লেবুর রস এবং শুকনো বাদাম ভাজার টুকরো মিশিয়ে। আর একটা পদ হল কোড়ানো পেঁপে অল্প তেলে জিরে-সরষে ফোড়ন দিয়ে নুন-লঙ্কা-হলুদ দিয়ে আধভাজা করে একটা সবজি। সবাই কী তৃপ্তি করে চেটেপুটে খেল। এমন অনবদ্য বনভোজন — ভাবাই যায় না।
কথায় কথায় নিশার কাছে জানলাম, বনবাড়ির সামনেই ১০ একর জমিতে একটা নির্মাণের কাজ চলছে। সেখানে ১১০টা প্লট করে বিক্রি করা হবে। বাংলোবাড়ি-টাড়ি গোছের কিছু হবে। চাষ-আবাদের ব্যাপার নেই। বুঝতে পারলাম এই প্রত্যন্ত জঙ্গলের মধ্যেও নিস্তার নেই!
বিকেলের দিকে আমি আর জিতেন মুম্বই ফেরার পথ ধরলাম। অটো আসতে দেরি করায় লিঠে রুকস্যাক আর কাঁধে ব্যাগ চাপিয়ে আমরা হাঁটা শুরু করলাম। ওরা চলল আমাদের এগিয়ে দিতে এবং কিছুটা দূরে গ্রামের মধ্যে বুয়ার বাড়ি ঠেকে ওঁর ছেলেকে ডেকে আনতে যাতে গাছপালা লাগানোর কাজ কিছুটা করা যায়। চড়াই রাস্তায় আমরা হাঁপিয়ে যাচ্ছি দেখে ওই মেয়েরা এক এক করে আমাদের কাঁধের বোঝা নিজেরা নিয়ে নিল। আর বুয়ার বাড়িতে পৌঁছে ওদের দেখাদেখি সবাই ধান ঝাড়ার কাজ করতে শুরু করল মহা আনন্দে। ইতিমধ্যে অটো এসে গেল — সবাইকে বিদায় জানিয়ে ফেরার পথ ধরলাম। মনে হল, এক স্বপ্নের জগৎ ফেলে এলাম।
Leave a Reply