লোসার উৎসবের আমেজে সারাদিন গা ভাসিয়ে সন্ধ্যেবেলায় যখন রোভার্স ইন-এ পৌঁছলাম, শরীরে আমাদের অনেকেরই পাহাড় ভাঙার এক রাশ ক্লান্তি। তা সত্ত্বেও একটু পরে আমরা তোড়জোড় শুরু করলাম বক্সা পাহাড়ে শেষ রাতটা অন্য রকমভাবে কাটাবো বলে। আসলে ইন্দ্র থাপা সকালেই বলে রেখেছিলেন, রাতে ক্যাম্প ফায়ার হবে, যে পাহাড়ে আছি তার চূড়ায় একটি ছোটো সমতল। আগে দিনের আলোতেই দেখে রেখেছিলাম, অপূর্ব সুন্দর ভিউ পয়েন্ট। তিনদিকে অতলস্পর্শী খাদ। অজস্র জানা অজানা গাছ মাথা তুলেছে খাদের কালো অন্ধকার থেকে। যাই হোক, খানিকটা বিশ্রাম করেই সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ রোভার্স ইনের পেছনের ভিউ পয়েন্টে পৌঁছে দেখি ইন্দ্রদা ইতিমধ্যেই আগুনের ব্যবস্থা করেছেন। আগুনের চারপাশে অস্থায়ী কাঠের বেঞ্চে বসার ব্যবস্থা।
ব্যাঞ্জো হাতে ইন্দ্রদা এলেন। বাদ্যযন্ত্রটি তাঁর নিজের হাতে তৈরি। হারমোনিয়ামের মতো সামনে একসারি রিড। ঠিক তার পেছনেই একটি ধাতব তার। যেটাকে উনি একটা প্লেকটার্ন দিয়ে বাজান। আমাদের চমকে দিয়ে শুরু করলেন একেবারে রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে — ‘বড়ো আশা করে এসেছি …।’ তারপর একের পর এক রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং কালজয়ী বাংলা গান। আমরা স্তম্ভিত এই ভেবে পশ্চিমবঙ্গের এক পাহাড়ি জেলায়, সভ্যতার মূল স্রোত থেকে নিতান্ত বিচ্ছিন্ন এক ছোট্ট জনপদে কী করে এক পাহাড়ি মানুষ বাংলা ভাষাটাকে এত ভালোবেসে ফেলেছে। যেখানে বাংলা বলার সুযোগ প্রায় নেই, সেখানে এই উপজাতীয় মানুষটি কী পরম নিষ্ঠায় বিশ্বকবির অর্চনা করে চলেছেন। প্রায় সেই শৈশব থেকেই — সেকথা তাঁর কাছেই শুনতে পেলাম। পাহাড় চূড়া তখন ইন্দ্রদার গান, ব্যাঞ্জোর মূর্ছনা আর আমাদের গলা মেলানোয় মুখরিত হয়ে উঠেছে। সারাদিনের পাহাড় ভাঙার ক্লান্তি কোন অজান্তেই উড়ে গেল। ক্যাম্প ফায়ারের এই আলোকিত বৃত্তটুকু ছাড়া দূরে তখন গুচ্ছ নিকষ কালো পাহাড়ের সারি।
পরদিন সকাল হতেই ফেরার তাড়া। সারাদিনে একবার মাত্র একটা জিপ ছেড়ে সকাল আটটাতে সান্ডালাবাড়ি হয়ে আলিপুর দুয়ার যায়। আমাদের লক্ষ্য সেই বাহনটি। রোভার্স ইন-এর সামনে দাঁড়িয়ে একটা গ্রুপ ফোটো তুলে ইন্দ্রদাকে বিদায় জানালাম। এবার নামার পালা। একটু হাঁটতেই দেখা হয়ে গেল একদল ইউনিফর্ম পরিহিত ছেলেমেয়ের সঙ্গে, যারা ওই অত সকালেই চলেছে সেই জিপটা ধরে শহরের কোনো একটি স্কুলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। নামার ঢালু পথে আমাদের সতর্ক পা থমকে যাচ্ছিল বিপজ্জনক বাঁকগুলোতে। কিন্তু পাহাড়ি সেই ছেলেমেয়েগুলো উচ্ছ্বল ঝরনার মতোই দুদ্দার করে নামছিল অভ্যস্ত পায়ে। বক্সা পাহাড় জুড়ে তখন আলোর খেলা। অজস্র অচেনা পাখির ডাকে কান পাতা দায়। সোনালী রোদে দীর্ঘ বৃক্ষসারির মাথাগুলোয় যেন গলানো সোনার স্পর্শ। অনেক নিচে সাদা দুধের রেখার মতো আঁকাবাঁকা সশব্দ পাহাড়ি নদী। আমরা শহুরে মানুষগুলো আকুল হয়ে প্রকৃতিকে ভরে নিচ্ছিলাম চোখে আর হৃদয়ে। হঠাৎ মনে হল, পাহাড় ডুয়ার্সের সবচাইতে জনপ্রিয় পর্যটনস্থল দার্জিলিং যে এত মানুষকে আকর্ষণ করে তার অতীত গৌরবে, তার চাইতে অনেক বেশি ঐশ্বর্য নিয়ে বক্সা পাহাড় অপেক্ষা করে আছে দুয়োরাণীর মতো। দার্জিলিং-এর ঘিঞ্জি বসতি, জলকষ্ট, যানজট, রাজনৈতিক অস্থিরতা, নিকাশির চূড়ান্ত অব্যবস্থা আমাদের মতো উত্তরের অনেক মানুষকেই আজ দার্জিলিং বিমুখ করে তুলেছে। তাই প্রাণভরে শ্বাস নিতে বারে বারে ফিরে আসা যায় বক্সা পাহাড়ের এখনও প্রায় অকলুষিত এই অরণ্যবাসে। প্রকৃতি এখনও কত উদার কত প্রশস্ত এই সবুজ জনপদে।
পাহাড়ি রাস্তা ফুরিয়ে সমতলে যখন শহুরে রাস্তার দেখা মিলল, একবার পেছন ফিরে তাকালাম, বক্সা পাহাড়ের দিগন্তজোড়া সবুজের দিকে। জিপ ছুটছে, আমরা ফিরে যাচ্ছি দৈনন্দিন ব্যস্ততার নিজের বৃত্তে। সবুজের শোভা এখন ছুটছে পেছনের দেশে।
ভ্রম সংশোধন : দ্বিতীয় পর্বের লেখায় ‘কুকুরের মাংস’-র বদলে ‘শূকরের মাংস’ হবে ।
রামজীবন ভৌমিক ও স্নেহাশিস দত্ত চৌধুরি, কোচবিহার, ১৩ মে, ছবি লেখকের
Leave a Reply