সংবাদমন্থন প্রতিবেদন, ২৫ অক্টোবর। ফুকুশিমা পরমাণু প্রকল্পটি, যা ২০১১ সালের মার্চ মাসে সুনামিতে বিপর্যস্ত হয়েছিল, তা এখনও এক ভয়ঙ্কর পর্বের মধ্যে দিয়ে চলেছে। এই চলা গোটা মনব সভ্যতার পক্ষেই কতটা বিপজ্জনক, তা টের পাওয়া যাবে না কর্পোরেট বড়ো মিডিয়াতে সীমাবদ্ধ থাকলে। সারা বিশ্বের বিকল্প মিডিয়ার উদ্যোগে একের পর এক ফাঁস হচ্ছে ফুকুশিমার সঙ্কট। আমরা সেই সতর্কবানী আগে প্রকাশ করেছি। এবার থেকে ধারাবাহিক ভাবে সেই সঙ্কট পর্বের বিবরণ প্রকাশ হবে, বিভিন্ন আপডেট-এর মাধ্যমে। #
সূত্র ফুকুলিকস
২০১১ সালের ১১ মার্চ ফুকুশিমায় সুনামির ধাক্কায় যে পরমাণু বিপর্যয় হয়, তখন ফুকুশিমা পরমাণু প্রকল্পের চার নম্বর ইউনিটের চুল্লি বন্ধ ছিল। সেই কারণে চুল্লি চালু থাকার কারণে যে বিপদ (সেগুলি ঠান্ডা রাখার ব্যবস্থা অচল হয়ে যাওয়ায় শেষমেশ মেল্টডাউন বা পরমাণু গলন ঘটে যাওয়া) অন্যান্য চুল্লিগুলিতে দেখা দিয়েছিল, সেই বিপদে পরেনি চার নম্বর ইউনিট। কিন্তু এই ইউনিট যে কারণে তখন বন্ধ ছিল, তাই এখন নয়া সঙ্কটের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওই চুল্লিটি ওই সময় বন্ধ থাকার কারণ, তখন ওই চুল্লিতে জ্বালানি বদল চলছিল। অর্থাৎ পোড়া (আসলে আধপোড়া) জ্বালানি সরিয়ে ওই চুল্লিরই বিল্ডিং-এর ভেতরে অস্থায়ী জ্বালানি কুলুঙ্গিতে রেখে নয়া জ্বালানি ভরা হচ্ছিল তখন চার নম্বর ইউনিটটিতে। ফলে যখন বিপর্যয় হয়, তখন চার নম্বর ইউনিটটির মধ্যে রয়েছে সম্পূর্ণ পোড়া জ্বালানি এবং একদম নতুন জ্বালানি। ওই বিপর্যয়ে চার নম্বর ইউনিটটির কাঠামোটি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে চার নম্বর ইউনিটটির জ্বালানি কুলুঙ্গি যে কোনও সময় ভেঙে পড়তে পারে। আর ভেঙে পড়লে কি হবে? আমরা জানি জ্বালানি কুলুঙ্গিতে জ্বালানি দন্ডগুলো থাকে জারকোনিয়ামের আবরণে জলের মধ্যে। ওই জল যদি কোনওভাবে বেরিয়ে যায়, তাহলে বায়ুর সংস্পর্শে এলে জারকোনিয়াম জ্বলে উঠবে, উন্মুক্ত হয়ে যাবে জ্বালানি দন্ডগুলো, এবং সেগুলির মেল্টডাউন শুরু যাবে। যা থেকে যে পরিমাণ বিকিরণ বাতাসে নিসৃত হবে, তা চের্নোবিলের বেশ কয়েকগুন।
এই আশঙ্কার কথা বিভিন্ন মহল থেকে উঠে আসার পর জাপানের ফুকুশিমা পরমাণু প্রকল্পের মালিক টেপকো কোম্পানি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ওই জ্বালানি কুলুঙ্গি থেকে জ্বালানি দণ্ডগুলি সরিয়ে নেবে, এবং ওগুলোকে রাখবে ওই চুল্লির ৫০ মিটারের মধ্যে অবস্থিত সাধারণ জ্বালানি পুকুরের মধ্যে। আপাতত রেহাই পাওয়ার জন্য এই ব্যবস্থা। সমস্ত পরমাণু প্রযুক্তিবিদরা একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছে, এই কাজটি দুরূহ। ওই চুল্লিগুলির ডিজাইন যা, তাতে এত ভঙ্গুর একটি বিল্ডীং-এর মধ্যে গিয়ে ওই জ্বালানি কুলুঙ্গি থেকে জ্বালানি দন্ডগুলো বের করে আনা একটা ইঞ্জিনিয়ারিং চ্যালেঞ্জ। এবং টেপকোর যা ক্ষমতার পরিচয় এতদিন ধরে পাওয়া গেছে, তাতে তাদের পক্ষে এটা পেরে ওঠাই কঠিন। আর দ্রুত এটি ঘটাতেও হবে, না হলে নিজে থেকে না হলেও পরের ভূমিকম্পেই ওই বিল্ডিংটাই ভেঙে পড়বে এবং মেল্টডাউন হয়ে যাবে। তাই জন্য পরমাণু প্রতিরোধকারী কর্মীরা প্রস্তাব রেখেছিল, শুধু টেপকো বা জাপান নয়, সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মনীষা ব্যবহার করে এই কাজে দ্রুত অবতীর্ণ হওয়া দরকার।
৭ অক্টোবর জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে এই প্রস্তাবে কিছুটা সহমত হতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স প্রভৃতি ছ’টি পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দেশের ছ’জন ইজনিনিয়ারকে নিয়ে একটি পর্যবেক্ষক কমিটি গঠন করা হয়েছে এই কাজ দেখভাল করার জন্য। তবে বাস্তবত কাজটি করছে টেপকোই।
টেপকো কীভাবে কাজটি করবে তার একটি ব্লু-প্রিন্টও প্রকাশ করেছে। তারা বলেছে, জ্বালানি বের করে আনার জন্য ভাঙাচোরা রিয়াক্টর বিল্ডিং-টির ওপর একটি ডিফুয়েলিং-বিল্ডিং বানানো হয়েছে, এবং সেটা বেশ শক্তপোক্ত, ছিদ্রহীন এবং তার নিজস্ব হিটিং-ভেন্টিলেশন ও এয়ার কন্ডিশনিং সিস্টেম (এবং বেরিয়ে যাওয়া বাতাস ফিল্টার করার ব্যবস্থা) আছে। তাই জ্বালানি বের করে আনার সময় যদি কোনও দুর্ঘটনা ঘটেও তাহলে ওই বিল্ডীং-এর বাইরে বিকিরণ বেরিয়ে আসতে পারবে না। যদিও ধারণা করা যায়, এই আপাত কাজ চালানোর জন্য তৈরি করা বিল্ডিং-টি কোনও দুর্ঘটনার জন্য যথেষ্ট নয়। ওই বিল্ডিং-এ একটা স্টিলের কাঠামোর মধ্যে দুটি ক্রেন বসানো হয়েছে। একটা নতুন ফুয়েল বইবার বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন ক্রেন ও অন্যটি সাধারণভাবে বড়ো যন্ত্রপাতি বহন করার উপযুক্ত ক্রেন। টেপকোর দাবি, এই জ্বালানি বহনে সক্ষম ক্রেনটি অটোমেটিক, কম্পিউটার চালিত। টেপকোর পরিকল্পনা, ওই বিল্ডিং-এর মধ্যে থেকে যতটা পারা যায় কংক্রিটের চাঙর সরিয়ে নিয়ে, তারপর জ্বালানির কী অবস্থা তা পরীক্ষা করে, তারপর জ্বালানি সরানোর কাজ শুরু করা হবে।
চারনম্বর বিল্ডিং-টির অবস্থা কতটা খারাপ? এই প্রশ্নের উত্তরে টেপকো জানিয়েছে, তারা পরীক্ষা করে দেখেছে, ভূমিকম্পে কিছু হবে না। কিন্তু পরীক্ষা করা হয়েছে শুধু ভার্টিকাল বা উল্লম্ব কম্পনের ওপর। যদি আনুভূমিক কম্পন হয় তাতে বিল্ডীং-টির কী দশা হবে তা পরীক্ষা করা হয়নি।
জ্বালানি কুলুঙ্গিটির নিজেরই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল ২০১১ সালের মার্চ মাসের বিপর্যয়ে। তা তখন সারানো হয়েছিল। কুলুঙ্গিটির নিজেরই একটা ঠান্ডা রাখার বন্দোবস্ত ছিল, যা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কোনওমতে জলের স্ফুটনাঙ্কের নিচে রাখা হয়েছিল কুলুঙ্গিটিতে জ্বালানি ডুবিয়ে রাখা হয় যে জলে, তার তাপমাত্রা। ওই বিল্ডীং-এর পাঁচতলায় কিছু সারাইকার্য করার সময় টেপকো কুলুঙ্গিটি একটি আপতকালীন ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দিয়েছিল। সেই থেকে আজ অবদি জ্বালানিগুলি কুলুঙ্গিতে কী অবস্থায় আছে, তা কখনও খতিয়ে দেখা হয়নি। গত কয়েকমাসে কিছু রিপোর্ট তৈরি করলেও তাতে কোনও বিশদ বিবরণের হদিশ নেই।
কুলুঙ্গিতে জল ভরে রাখার জন্য লাইনার-এর অবস্থাটা ভালো হতে হয়। যে জ্বালানি দরজা দিয়ে চুল্লির কুয়ো এবং জ্বালানি কুলুঙ্গিটি পৃথক করা হয়, তার এখন কী দশা কেউ জানে না। বিপর্যয়ের প্রথম ক’মাসে টেপকোর তরফ থেকে বলা হয়েছিল, এইখান দিয়েই লিক করে জল পড়ছে। একথা ধরে নেওয়া যায়, যে ফোলানো সিল দিয়ে এই দরজার ফুটো বোঁজানো থাকে, তা এখন কাজ করছে না, কারণ ওই ফোলানোর কাজটি হয় বিদ্যুতের সাহায্যে এবং সেটি এখন অকেজো। তাই কুলুঙ্গির মধ্যে জলের বর্তমান রসায়ন কী, তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখা দরকার, কিন্তু এখনও পর্যন্ত তার কোনও প্রমাণ টেপকোর রিপোর্টে পাওয়া যায়নি। ২০১২ সালে ওই জল থেকে লবণ বার করা হয়েছিল, কারণ লবণে ক্ষয় হয়। অনেকদিন ধরে ওই জল লবণাক্ত হয়ে থাকায় (০.১ শতাংশ সোডিয়াম ক্লোরাইড ১০০০ পার্টস পার মিলিয়নে) কুলুঙ্গির যন্ত্রাংশ এবং জ্বালানি দণ্ডের আবরণগুলির ক্ষতি হওয়ারই সম্ভবনা।
জ্বালানি রডের সঙ্গে থাকে সেগুলো ধরার জন্য জ্বালানি হ্যান্ডল। টেপকো বিপর্যয়ের পরপরই ৪ নম্বর ইউনিট থেকে কিছু নয়া জ্বালানি বের করে ছিল পরীক্ষা নিরিক্ষার জন্য। তারা ঘোষণা করেছিল, এগুলো একটুখানি ক্ষয় হয়েছে মাত্র। ওই জ্বালানি সমষ্টির মধ্যে থেকে ছোটো ছোটো কংক্রিটের চাঙরও পাওয়া গেছিল। পরীক্ষা করার জন্য টেপকো একটি জ্বালানি-সমষ্টির ওপর একট ১০০ কেজি ওজনের কংক্রিটের চাঙর ফেলে দিয়েছিল। তাতে দেখা গেছিল, জ্বালানি-সমষ্টির হ্যাণ্ডলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। সেইজন্য জ্বালানি-সমষ্টিগুলি বেরা করা সময় ব্যবহার করার জন্য নতুন হ্যাণ্ডল বানিয়েছে টেপকো। যদিও এই হ্যাণ্ডলটি পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে কিনা তা টেপকো জানায়নি।
চলতি সময়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, কুলুঙ্গির কিছু জ্বালানি সারি সরলরেখায় নেই। তার মানে দাঁড়ায়, সম্ভবত ফিসন আটকানোর জন্য রাখা বোরোন চেম্বারগুলিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং জায়গা থেকে সরে গেছে। হতেই পারে, জ্বালানিগুলো বের করার সময় মধ্যে ঢুকে থাকা কংক্রিট এবং অন্যান্য সরণের কারণে জ্বালানি দণ্ডগুলি ধরে বের করে আনাই দুষ্কর হয়ে দাঁড়াবে।
তাছাড়া গত আড়াই বছর ধরে এটির ওপর দিয়ে আরও অনেক ঝাপটা বয়ে গেছে। তার ফলে ওই জ্বালানিগুলো কী দশায় রয়েছে, তা বলা মুশকিল।
এছাড়া সবচেয়ে বড়ো সমস্যা মানুষ নিয়ে। টেপকোর দাবি, এই কাজ গোটাটাই হবে দূর-নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু তিন নম্বর ইউনিটের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, দূর-নিয়ন্ত্রিত কাজে সবসময় মানুষকে কাছে গিয়ে দেখে আসতে হয়ব্যাপারটা। তার ওপর এখানে ক্যামেরা দেখবে জলের মধ্যে দিয়ে। ফলে ক্যামেরার পক্ষে একদম ঠিকঠাক ছবি দেওয়া সম্ভব হবে না। ফলে মানুষ যেতে লাগবেই। মানুষ গেলেও তাদের খুবই অভিজ্ঞ হতে হবে এই চুল্লিগুলির ব্যাপারে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, গত আড়াই বছর ধরে কাজ কর করে অভিজ্ঞ শ্রমিকদের বেশিরভাগই তাদের জীবদ্দশায় যে সর্বোচ্চ পরিমাণ বিকিরণ গ্রহণ করতে পারেন, তা ছুঁয়ে ফেলেছেন, ফলে আর কাজে লাগতে পারবেন না।
ক্রেনে করে জ্বালানি দণ্ডগুলোকে বেরকরে নিয়ে এসে বাইরের সাধারণ জ্বালানি পুকুরে রাখার আরও এক বিপদ আছে। সেটা হলো ক্রেন জনিত কোনও দুর্ঘটনা। একবার যদি ক্রেন ছিঁড়ে যায় ও জ্বালানি-সমষ্টি সেখান থেকে খুলে পড়ে যায়, তাহলে মারাত্মক বিপদ হবে আশেপাশে যে শ্রমিকরা কাজ করছে তাদের। তা ছাড়া, সাধারণ পুকুরে রাখার সময় যদি তা ছিঁড়ে পরে, তাতে পুকুরটিরও ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা আছে। যে তাড়াহুড়োর মধ্যে কাজটি করা হচ্ছে, তাতে পদে পদে দুর্ঘটনার সম্ভবনা।
Leave a Reply