১১ মার্চ, অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস চত্বর, কলকাতা, তমাল ভৌমিক#
২০১১ সালের ১১ মার্চ জাপানের ফুকুশিমাতে ঘটেছিল দাইচি পরমাণু কেন্দ্রে ভয়াবহ বিপর্যয়। প্রশান্ত মহাসাগরের কাছে অবস্থিত এই কেন্দ্রে সুনামির জল ঢুকে ওই বিপর্যয়ের শুরু, এখনও তার রেশ চলছে। তখনই ভূমিকম্প ও সুনামিতে ফুকুশিমায় মারা গিয়েছিল ১৫৯৯ জন। আর পরমাণু বিপর্যয়ে উদ্বাস্তু হয়ে গেছে ওখানকার ১,৬০,০০০ মানুষ, যাদের মধ্যে ১৬০০ জন মারা গেছে ২০১৩-র ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এরই মধ্যে ৭৫ জন ফুকুশিমা-শিশু তেজস্ক্রিয় বিকিরণের ফলে থাইরয়েড ক্যানসারের শিকার। এখনও হাজার হাজার টন তেজস্ক্রিয় জল প্ল্যান্ট থেকে লিক করে মিশছে ভূ-গর্ভস্থ জলের উৎসে, মাটিতে, সমুদ্রে, যার ফল ভুগছে এবং ভুগবে কাছে এবং দূরের পৃথিবীজোড়া অনেক মানুষ। এমনকী সুদূর আমেরিকা, পর্যন্ত এই তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছে বলে জানা গেছে। \par
আজ এই ঘটনাকে মনে রেখে, ‘ফুকুশিমা আর নয়’ আওয়াজ তুলে ফুকুশিমা দিবস পালন কবল ‘রিমেম্বারিং ফুকুশিমা কমিটি’। আকিঞ্চন, বিজ্ঞানবার্তা, অনীক, নান্দীমুখ, পারোজিয়া, দামামা, মন্থন, তবু বাংলার মুখ ইত্যাদি ছোটো পত্রিকা এবং এনএপিএম, নেহাই কালচারাল ফোরাম, দিশা, আর্থকেয়ার, কাশীপুর কিশোরভারতী বিদ্যালয়, সিইএসটিইউএসএস, কাঁচড়াপাড়া বিজ্ঞান দরবার সহ বিভিন্ন সংগঠন ও বিভিন্ন ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে ‘রিমেম্বারিং ফুকুশিমা কমিটি’। এই কমিটি আজকের এই অনুষ্ঠানের আগে দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়েছে। বিশেষত কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী জেলার বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে কেন ফুকুশিমা দিবস পালন করা উচিত, কীভাবে পরমাণু মুক্ত পৃথিবীর দিকে সবাই মিলে এগিয়ে যাওয়া প্রয়োজন সে বিষয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে বক্তব্য রেখেছে এবং শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদেরকে ছাত্রদের নিয়ে এই অনুষ্ঠানে আসতে রাজি করিয়েছে।
রিমেম্বারিং ফুকুশিমা কমিটির আহ্বানে এদিনের অনুষ্ঠানে কাশীপুর কিশোরভারতী বিদ্যালয়, সোদপুর শ্রীমন্ত বিদ্যাপীঠ, আকড়া গার্লস মাদ্রাসা, আকড়া হাই মাদ্রাসা, বড়তলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়, গোপবন্ধু ইনস্টিটিউশন, সাউথ ক্যালকাটা গার্লস হাইস্কুল, শান্তি সঙ্ঘ শিক্ষামন্দির ও শ্রীরামপুর শ্রমজীবী বিদ্যালয় থেকে প্রায় একশো কুড়িজন ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে পনেরজন শিক্ষক হাজির হয়েছিলেন এই অনুষ্ঠানে।
অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল সকাল ৯টা থেকে। অ্যাকাডেমি অফ্ ফাইন আর্টসের সামনের চত্বরে সকাল থেকেই উদ্যোক্তারা হাজির হয়ে গিয়েছিল। নানান পোস্টার-ব্যানার টাঙিয়ে টেবিল চেয়ার পেতে বসে গিয়েছিল বিভিন্ন সংস্থা তাদের পত্র-পত্রিকা নিয়ে। সঙ্গে যোগ দিয়েছিল নদিয়া থেকে আসা কয়েকজন চাষি তাদের জৈব পদ্ধতিতে প্রস্তুত বিভিন্ন সবজির ডালি নিয়ে। চারিদিকে কতরকমের পোস্টার প্রদর্শনী। কোথাও ফুকুশিমার পরমাণু বিপর্যয়ের ছবি ও তার নানা আশু ও দীর্ঘমেয়াদী বিপদের বর্ণনা, কোথাও ভারতবর্ষে পরমাণু প্রকল্প বিরোধী আন্দোলনের — বিশেষত কুডানকুলামের সাম্প্রতিক আন্দোলনের ছবি, কোথাও পরমাণুশক্তির বিকল্প হিসেবে সৌরশক্তি ব্যবহারের সম্ভাব্যতা তুলে ধরা হয়েছে, কোথাও আবার পরিবেশ বান্ধব ও স্বাস্থ্যরক্ষাকারী জৈব চাষের কথাও তুলে ধরা হয়েছে পোস্টার প্রদর্শনীতে।
হায়ার সেকেন্ডারী পরীক্ষার আর একদিন বাকি। তাই মাইকের পারমিশন পাওয়া যায়নি। একটা ব্যাটারি চালিত ছোটো হ্যান্ডমাইকেই বক্তারা বক্তৃতা শুরু করলেন। তার আগে নেহাই-এর গানের দল গান শোনালো, পরমাণু শক্তি বিরোধী লড়াইয়ের গান। যাদুগোড়া থেকে এসেছিলেন ওখানকার ইউরেনিয়াম কর্পোরেশনের ইউরেনিয়াম উত্তোলন বিরোধী আন্দোলনের কর্মীরা। তারা জানালো, বহুদিন ধরে তাদের লড়াই চলেছে, ফুকুশিমা বিপর্যয়ের অনেক আগে থেকেই তারা ইউরেনিয়ামের মতো বিপজ্জনক তেজস্ক্রিয় জিনিস নিয়ে মানুষের নাড়াচাড়ার বিপক্ষে বলে আসছে; তারা যাদুগোড়ায় ভুক্তভোগী। ওখানকার স্থানীয় মানুষ হিসেবে তারা ও তাদের সন্তান-সন্ততি সহ অঞ্চলের পশুপাখি, গাছপালা, সমস্ত পরিবেশ কীভাবে ক্যানসারের মতো মারাত্মক অসুখে আক্রান্ত হয়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, সে বিষয়ে ৪০-৫০ বছর ধরে তারা বলে আসছে; তাদের কথা বিদেশের নানা জায়গায়ও পৌঁছেছে। কিন্তু দেশের মানুষের কানে পৌঁছায়নি বলে তারা দুঃখ প্রকাশ করল; দুঃখ প্রকাশ করল রাষ্ট্রের ক্ষমতাধররা তাদের কথা কানে তুলছে না বলে। অনেক বক্তাই অনেক কথা বলল। তার মধ্যে কানে লেগে আছে ঘনশ্যাম বিরুলির একটা কথা — ইউরেনিয়াম নিষ্কাশন বন্ধ হলে যে পরমাণু শক্তি বা পরমাণু বোমা বানানোর কোনো সম্ভাবনাই থাকবে না, তা বোঝানোর জন্য তিনি বললেন, ‘না রহে বাঁশ, না বাজেগা বাঁশরী’।
চারিদিকের রঙবেরঙের পোস্টার প্রদর্শনী আরও বর্ণময় হয়ে উঠল দুপুর দেড়টা নাগাদ, যখন ছাত্র-ছাত্রীর দল এসে অনুষ্ঠানের প্রাঙ্গণ ভরিয়ে দিল। দুপুরের দারুণ তাপ ভুলিয়ে দিয়ে কচিকাঁচা মুখগুলো আলোচনায় অংশগ্রহণ করল। প্রথমে ফুকুশিমা বিপর্যয় ও পরমাণু শক্তির বিপদ এবং তার হাত থেকে নিষ্কৃতির উপায় নিয়ে বিশেষজ্ঞরা আলোচনা করলেন, তারপর প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রী তাদের হাতে তুলে দেওয়া একটা নির্দিষ্ট সাদা কাগজে তাদের ইচ্ছেমতো একটা-দুটো প্রশ্ন লিখে জমা দিল উদ্যোক্তাদের হাতে। এরপর ওই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিলেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞ হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রবীণ অধ্যাপক ও বিজ্ঞানীরা। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সুজয় বসু, সমর বাগচী, মেহের ইঞ্জিনিয়ার, তুষার চক্রবর্তী, প্রদীপ দত্ত ও মনোজ কুমার পাল। সমগ্র অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন শান্তনু চক্রবর্তী।
আলোচনার পরে দুপুর তিনটে নাগাদ ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য যে টিফিনের ব্যবস্থা ছিল তাতে স্যান্ডউইচের সঙ্গে দেওয়া হল নানারকম ফলফলাদি সেগুলো জৈবভাবে প্রস্তুত। খেতে খেতেই জৈবখাদ্যের গুণাগুণ সম্পর্কে ছাত্র-ছাত্রীরা ‘শ্যামলী’ গোষ্ঠী কর্মী অপরাজিতার কাছ থেকে জেনে নিল। জেনে নিল কীটনাশকবিহীন খাদ্যের উপকারিতা আর রাসায়নিক সারের প্রস্তুত খাদ্যের অপকারিতার কথা।
এরপর বিকেল চারটে নাগাদ শুরু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রথমে সুশান্ত দাস মূকাভিনয় করে দেখালেন একটা সামুদ্রিক মাছের চোখে কুডানকুলামের ধীবরগোষ্ঠীর পরমাণু প্রকল্প বিরোধী লড়াইয়ের কাহিনি। এই মাইমের পর ‘কাগজের খেয়া’ গোষ্ঠীর সউদ আলি মোল্লার পরিচালনায় নাটক মঞ্চস্থ হয় ‘এগারোই মার্চ’। তারপর শেষে পাঁচটার কিছু পরে আধঘন্টার এক তথ্যচিত্র দেখানো হল। পারমাণবিক শক্তির বিপদ, ফুকুশিমার বিপর্যয় ও পরমাণুমুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলার বিষয়ে। এই তথ্যচিত্রটি তৈরি করেছে প্রমিত, পাভেল এবং অরিন্দম মজুমদার। সব মিলে অনুষ্ঠান শেষ হল সন্ধ্যে ছটার পরে।
Leave a Reply