সংবাদমন্থন প্রতিবেদন, ১৫ অক্টোবর#
ফলতা সেজের ৪নং সেক্টর পেরিয়ে গেলে শুরু হল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ সেন্টার। এর সামনের রাস্তা ধরে নীলার দিকে যে রাস্তা এগিয়েছে তার কাছে যেখানে ঝিঙের পোল (একটি কালভার্টের নাম, তলা দিয়ে নদী থেকে সোঁদা খাল ঢুকেছে, এখানে রাস্তার যেদিকে নদীর সাইড সেই অংশে প্রচুর ঝিঙে চাষ হয়, তা আমতলা মার্কেটের পাইকাররা কিনে সারা রাজ্যে বিক্রি হয়। তাই এই নাম) তার একটু আগে যে বিরাট কারখানাটা রয়েছে ওটার নাম কোহিনুর পেপার মিল।
২০০৯ নাগাদ এই পেপার মিলটা চালু হয়। একেবারে প্রথম দিকে সেটা আগস্ট হবে, তখন ৪ জন শ্রমিক মাল লোড-আনলোড করার কাজ করত। এই সময় রোজ ছিল ৭৫ থেকে ৮০ টাকা। তখনও পুরোদমে কাজ শুরু হয়নি। ২০১০ এর মার্চ-এপ্রিল নাগাদ কাগজ সর্টিং আর পাল্পার পদের জন্য লোক নেওয়া হয়, তা প্রায় ৩৭ জন। এর পর নভেম্বর নাগাদ এটা বেড়ে প্রায় ৮০ জন লোক দাঁড়ায়। তখন কারখানায় চারটে কন্ট্রাকটার (টুসু, জাকির, কমল, রবীন) কাজ করত। এদের মধ্যে টুসু বাদে বাকিরা স্থানীয় হওয়াতে তাদের জোর ছিল বেশি। তাই ৭৫ টাকা রোজে কাজ করাতো আর টুসুই একমাত্র ৮০ টাকা রোজ দিত। কেউই পিএফ, ইএসআই-এর বালাই রাখেনি। টুসুর কাছে যারা কাজ করত, তাদের ইএসআই-এর কার্ড হয় ২০১১-র নভেম্বর মাসে। আর সবার কাছে এইসব ফেসিলিটির কথা জানতে চাইলে জবাব দেওয়া হত ২০১২-তে স্মার্ট কার্ড হবে তাতে করে জোকা ইএসআই অফিসে পুরো ফ্যামিলির চিকিৎসার বন্দোবস্ত হবে। ২০১০-এর মার্চ নাগাদ দীপক হালদার নামে এক শ্রমিক সকালের কাজ করে বাড়ি ফেরার পর আবার তাকে কাজ করার জন্য কোম্পানি ডাকে, রাতের শিফটে কাজে যেতে। সেই লেবারটি কাজে যায়। কিন্তু ক্লান্তিজনিত কারণে পেপার পাল্পের যে প্রেসিং মেসিন তাতে তার দুটি হাত ঢুকে যায়, কাঁধ থেকে ছেড়ে যায়, তিনি মারা যান। প্রথমে সুপারভাইজাররা চেয়েছিল বডি বয়লারে দিয়ে লোপাট করতে। কিন্তু লেবারদের চাপে তা পারেনি। যদিও একটা হাত কাগজের গাদায় লুকিয়ে ফেলে। পুলিশ এসে শ্রমিকদের চাপে তা উদ্ধার করে। এরপরে শ্রমিকদের প্রেসারে ৪০,০০০ টাকা (দাহকাজের জন্য) আর ৮লাখ টাকা (ক্ষতিপূরণ) দেবে বলে রাজি হলেও শেষে ২০,০০০ ও ৪ লক্ষ টাকা দেয়। আর তার বউকে তাদের ক্যান্টিনে একটা কাজ দিয়েছে অনেক টালবাহানার পর।
দিলীপ মণ্ডল এখানকার এক ইউনিয়ন লিডার। তিনি গোড়া থেকেই প্রতিদিন ২ টাকা জনপ্রতি ফান্ডের নামে চাঁদা তুলতেন। এমনকী এও নাকি কানাঘুষো শোনা যায়, যারা সরিষা, শিবানীপুর অঞ্চলের থেকে কাজ করতে আসে তাদের কাছ থেকে ৫০০০-১০,০০০ টাকাও নেওয়া হয়েছে। যারা কখনো এসব নিয়ে বলেছে, প্রতিবাদ করেছে, মাইনে বাড়ানোর কথা বলেছে তাদের গেটপাস কেড়ে নিয়ে বার করে দেওয়া হয়েছে। এভাবেই ৮০/৯০ জনকে বাদ দেওয়া হয়। এজন্য বটি তোলার জন্য যেমন জমিদারদের আগে লোক থাকত তেমন এদেরও লোক থাকত। তাকে কিছু পাওয়ারও দিয়েছিল। যদিও ওকে টাকা দিত কেবল পেট চালানোর মতো হাজার দুয়েক টাকা। ২০১০-এ একবার পুজোর আগে বোনাস দিতে হবে এই দাবিতে লেবাররা আন্দোলন শুরু করে। শোনা কথা, এই দিলীপ মণ্ডল মালিকপক্ষের সাথে কারসাজি করে বোনাস হিসাবে একটা জামার পিস (ছেলেদের) আর শাড়ি (মেয়েদের) রফা করে।
আর এটা আবার শ্রমিকদের মেনে নিতে বলে, যখন কিনা শ্রমিকরা কারখানা গেটের ভিতরেই বোনাসের দাবিতে ধরনা দিচ্ছে। শ্রমিকরা এই রফা মানতে রাজি না হলে পুলিশ দিয়ে তাদের পেটানোও হয়। তারপরে ২০১১-তে অবশ্য ৫০০ টাকা বোনাস দেওয়া হয়। ২০১২-র মার্চ-এপ্রিলে কিছু লেবারের সাথে দিলীপ মণ্ডলের ঝামেলা শুরু হয় রোজ বাড়ানো, ফান্ডের হিসাব দাবি করে। এরা আলাদা করে ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশনের দাবিও তোলে।
এপ্রিলের ১৪ তারিখে সকালের শিফটের শ্রমিকরা প্রতি মাসে মাইনে খুব দেরি করে দেওয়ার প্রতিবাদে কাজ বন্ধ করে দেয়। ১৫ তারিখে যে লেবাররা আগে দিলীপ মণ্ডলের সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে ছিল তারা কাজে যায় (১৪ তারিখে তারা নাইট করে সকালে বাড়িতে ছিল)। তখন সিকিউরিটি বলে, তাদের ঢুকতে দিতে মানা আছে। আর ঢুকতে দেয়নি। এভাবে ২২ জনকে আটকায়। এদের বাদ দেয়।
গত ১ অক্টোবর লেবার কমিশনারের কাছে মিটিং থাকলে সেখানে কোম্পানির এক ম্যানেজার সোনিজী বলেন — আমাকে মেরে ফেললেও এদের নেব না। লেবার কমিশনার তিনমাসের বেতন দিতে অনুরোধ করলেও, কেবল ১৫ দিনের বেতন দিতে রাজি হন। শ্রমিকরা তার বদলে ৫ মাসের মাইনে সাথে ৩ মাসের অ্যাডভান্স চায়। এর আগে ২০ সেপ্টেম্বর অ্যাসিস্ট্যান্ট লেবার কমিশনার অফিসে মিটিং থাকলেও সেখান এই ২২ জনের সাথে কিছু পৃষ্ঠপোষক যেতে চাইলে টিএমসি-র ছেলেরা সেখানে বাধা দেয়, ঢুকতে দেয় না।
Leave a Reply