পার্থ কয়াল, ফলতা, ১৫ জুলাই#
মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিক দুটো পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে। গ্রামের দিকে পাশ করাটা বড়ো ব্যাপার। আর পাশ করার পর আবার পড়তে ভর্তি হওয়াটাও। বেশিরভাগ জানে তাদের সরকারি চাকরিবাকরি কিছুই জুটবে না। তাই যত অল্প বয়সে কাজে ঢোকা যায় ততই ভালো। কাজের অভিজ্ঞতা বাড়বে, সাথে মাইনেও বাড়বে। সাধারণভাবে হিন্দু ঘরের ছেলেদের ক্ষেত্রে দেখা যায় কাঁচের জানলা ফিটিং, প্যানেল উইন্ডোর কাজ, হোসিয়ারিতে কাজ, পাশের ফলতা সেজের কাজ সাথে ফাঁকেতে সবজি চাষ, ধানের মরসুমে ধান চাষে হাত লাগানো, বা কলকাতায় মাঝেমধ্যে জোগাড়ের কাজে আসা, কখনো পশ্চিমবঙ্গের বাইরে সোনা রূপোর গয়না তৈরির কাজে যাওয়া এসব-ই চলতে থাকে। মুসলিম ঘরের ছেলেরা প্রথাগত ভাবে দর্জি জরির কাজে (এখন জরির কাজের বাজার মন্দা), যারা একটু ডাকাবুকো ধরনের তারা শেল্টারিং-এর কাজে/বড়ো বড়ো বিল্ডিঙের ডাক্টিং-এর কাজে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে চলে যায়।
হিন্দু ঘরের দুটো ছেলের সাথে গল্প করছিলাম, দুজনের মধ্যে একজনের বাবা কাছেই থাকে, কিন্তু ছোটোবেলা থেকেই ওদের দেখে না, আরেকজনের বাবার মাথা গরম, কাজে গিয়ে মালিকের সাথেই তর্ক জুড়ে দেয়। দুজন-ই ভেবেছিল আর পড়বে না, অবশেষে স্কুল থেকে পড়ার জন্য হেডমাস্টারমশাই ডাক পাঠিয়ে ভর্তি করেছেন, তা একজনের কাছ থেকে স্কুল টাকা নিয়েছে আর অন্য জনের কাছ থেকে ভর্তির টাকা নেয়নি। প্রথমে স্কুল বলেছিল সায়েন্স সাবজেক্টে ভর্তি হতে, কিন্তু ওরা জানে তাতে পড়ার খরচ আছে, বই চেয়েচিন্তে জুটলেও টিউশনের খরচ চালানো মুশকিল, তাই আর্টসেই ভর্তি হয়েছে। এরকম হাজারো ছেলেমেয়ে আছে যারা ভর্তি হলেও বই কেনার সামর্থ্য নেই, ক্লাসে আসে বসে থাকে গল্প করে আর চলে যায়। কেউ একবছর পড়া ড্রপ দিয়ে কারখানায় ঢোকে, আবার ভর্তি হয়, হেডস্যার বা অন্যদের ধরে কাজ আর পড়া দুটোই চালিয়ে যেতে থাকে।
মুসলিম ঘরের অবস্থা আলাদা কিছু নয়, ক্ষেত্র বিশেষে বরং খারাপ। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছে ফার্স্ট ডিভিশন বা তার কাছাকাছি নম্বর পেয়ে, বাড়ি থেকে বলছে আর পড়াতে পারবে না, এ তো আকছার ঘটছে। ধরা যাক একটি বাড়ির ইনকাম বলতে সম্বৎসরের চাষ — বোরো আর আমন, ছাগল পেলে দুধ বিক্রি, ছাগল বড়ো করে বিক্রি, হাঁস-মুরগির ডিম বিক্রি, সময়ে নারকোল বিক্রি, নারকোল পাতার থেকে কাঠি বিক্রি, কখনো জরির কাজ এসব করেই চলে তিনজনের সংসার — বাবা, মা, ছোটো ছেলে। বড়ো ছেলের পাশেই আলাদা সংসার। তিনজনের সংসারে ডেলি মুদি দোকানের খরচ গোটা চল্লিশ টাকা, তা সামলে পড়ার খরচ কোনোদিন ছোটো ছেলে বাড়ি থেকে হাত পেতে নেয়নি, পুরোটাই সেই ছোটো থেকে এর-ওর কাজ করে জোগাড় করেছে। এই সেদিনও বর্ষা নামার আগে অন্যের পুকুরে মাটি কেটে তিনদিনে আয় করেছে ৪৫০ টাকা, তারপর বৃষ্টি নামায় কাজ বন্ধ। এদিক সেদিক থেকে টাকা ধারধোর করে কলেজে ভর্তি হওয়া, সেখানে কলেজ কোনো কথা শুনতে রাজি না (যদিও শোনা যায় নাকি কেউ আর্থিক অসুবিধার কারণ দেখিয়ে আবেদন করলে কলেজ ফি মকুব করবে বা কমাবে — সাধারণভাবে পাশ কোর্সে আর্টস-এ ভর্তি হবার জন্য এককালীন ৯৫০ টাকা লাগছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজে)। ক্ষেত্র বিশেষে ছেলেরা যদি বদমাইশি করে টাকা না দেয় সেই ভয়ে আবার কোনো কলেজে ভর্তির কিছু টাকা বাকি রাখলে, পরে সেই ছাত্র যাতে না পালায় সেজন্য মুচলেকা লেখাচ্ছে। একটি ছেলের বাড়ি এমন জায়গায় সেখান থেকে কলেজে আসতে যাতায়াতে খরচ পড়ে ডেলি ২০ টাকা। ৫ টাকা হাত খরচ ধরলে ২৫ টাকা। সপ্তাহে দুদিন আসলে ৫০ টাকা, আর দু-একটা বই কেনার খরচ ধরলে (সমস্ত বই কেউ কেনে না) সাধারণত একটা পাড়ায় যারা এক-দুজন ভর্তি হল তারা কয়েকজন মিলে একই কম্বিনেশন নেয় যাতে একজনের টিউশনের খরচে বাকিদের চলে যায়। তাতেও সামলে ওঠার জন্য দলিজে সারা সপ্তাহ কাজ করতে হয়।
মুসলিম পরিবারের একটি মেয়ে উচ্চমাধ্যমিক ভালোভাবে পাশ করল, তারপরও পড়ার ইচ্ছে, কিন্তু পড়ার পথে বাধা হয় টাকা জোগাড় করা, যদি বা ভর্তির টাকার জোগাড় হল, কিন্তু বাড়ির সংসার চালাতে যে জরির কাজ চলে সেটা বন্ধ হয়ে যাবে পড়তে গেলে; আর বেশি লেখাপড়া জানা মেয়ের গরিবানা ঘরে কি পাত্র জোটে?
Leave a Reply