তমাল ভৌমিক, ভবানীপুর, ২৭ আগস্ট#
বৃন্দাবনের ফটো বা আলোকচিত্র প্রদর্শনী হচ্ছে ভবানীপুরে সরু গলির ভেতরে একটা ছোট্ট দোকানে। দোকানের নাম ‘ঋতু’, গলির নাম চন্দ্রনাথ চ্যাটার্জী স্ট্রীট। ঈদের দিন সন্ধ্যেবেলা পাড়ায় ঘুরতে ঘুরতে টুক করে ঢুকে পড়লাম। দোকানি রাজা ব্যাগ বিক্রি করে, পাহাড়ে চড়ার তাঁবু, স্লিপিং ব্যাগ ও অন্যান্য সাজসরঞ্জাম ভাড়া দেয়। আর ফটো তোলে। অবশ্য ফটো তোলার কায়দা-কানুনও শেখায় এই দোকানে বসে। খুবই ভালো ফটোগ্রাফার রাজা। ভালো নাম অভিমন্যু দত্ত। এবারের এই বৃন্দাবন নিয়ে প্রদর্শনী এর আগে ‘গ্যালারি গোল্ড’এ দেখানো হয়েছে। অনেক ছবি। সব এই ছোটো দোকানঘরে সাজানো যায়নি। তবু যেগুলো টাঙ্গানো হয়েছে, চমৎকার। প্রথমেই কপালে নাকে তিলক কাটা গলায় তুলসির মালা পরা এক বুড়িকে দেখে চমকে গেলাম, অবিকল আমার ঠাকুমা, আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। এমন জীবন্ত — ২০ বছর আগে মারা গেছেন মনেই হয় না। তাঁর চারপাশে কত মন্দির। রাজা বুঝিয়ে দিচ্ছিল, এগুলো ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীতে সম্রাট আকবরের আনুকুল্যে তৈরি, এটার নাম গোপীনাথ, এটা মদনমোহন, এটা যুগলকিশোর-লাল পাথরে তৈরি, যেরকম লাল পাথরে ফতেহপুর-সিকরির স্থাপত্যও গড়ে তোলা হয়েছে। পাশাপাশি ঊনিশ শতকে ব্রিটিশরাজের সময় তৈরি মন্দিরগুলোয় ইউরোপীয় ও দক্ষিণ ভারতীয় স্থাপত্যের ছোঁয়া। আর বৃন্দাবনের রাস্তাঘাট, পুরোনো সব বাড়ি, যেখানে সাধারণ মানুষ বাস করত সেগুলোর কারুকাজ দেখলেও চোখ ফেরানো যায় না। সবই ভেঙে ভেঙে পড়ছে। রাজা দুঃখ করছিল, এগুলো সবই ঐতিহ্যশালী অথচ কোনো সংস্কার নেই, দেখভাল করার কেউ নেই। ওই দেখুন আকাশ ছোঁয়া স্তম্ভ মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
সঙ্গে আছে ভক্ত বৈষ্ণবদের ছবি, বক্তৃতাবাজ পাণ্ডা পুণ্যার্থীদের বোঝাচ্ছে কোথা থেকে কতটা পয়সায় কতটা পুণ্য কিনে নিতে হবে। আর আছে ছাগল, গরু, বাঁদর। হাতিতে, দোলায় স্নানযাত্রায় মূর্তি নিয়ে যাওয়ার ছবি। উৎসব, আলো, চা-দোকানি, পথের ভিখারি, ভাঙ্গা বাড়ির দেওয়ালে টাঙ্গানো ছেঁড়া ক্যালেন্ডারের থেকে রাধা-কৃষ্ণ সবার দিকে তাকিয়ে আছে। সর্বোপরি যমুনার বাঁক, জলের বিস্তারে চরের ছায়া এমন ঘনিয়ে আছে মনে হয় গান শোনা যাচ্ছে, ‘বৃন্দাবন বিলাসিনী রাই আমাদের’। আমার একমাত্র সঙ্গী-দর্শক তো বলেই ফেলল, ‘ইস, বৃন্দাবন যাওয়া হয়নি। নাঃ এবার বৃন্দাবনই যাব।’
রাজা বলছিল, এইসব ঐতিহ্যবাহী সৌধগুলো সংরক্ষণের দাবিতে আমরা উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে একটা আবেদনপত্র পাঠাচ্ছি, আপনারা যদি একটু সই করে যান তাতে। আমি বললাম অবশ্যই। এই তো সত্যিকারের ফটোগ্রাফার যার ক্যামেরার ফোকাস চোখ থেকে মনে পৌঁছে যায়; চেতনা পেশীকে নাড়া দিয়ে বলে, কিছু করো, চোখে যা দেখছ তার জন্য কিছু করো।
Leave a Reply