পয়লা বৈশাখ বৌকে নিয়ে তার দিদির বাড়ি যাচ্ছি। দিদির অসুখ। তাকে দেখতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে ভোরবেলা হাওড়া এসেছি। হাওড়া থেকে মুন্সীর হাটের বাস ধরেছি। প্রথমে বেশ ভিড় ছিল। শেষের দিকে বাস ফাঁকা হয়ে এসেছে। সন্তোষপুর থেকে দুটো ছোটো মেয়ে আর এক বালক উঠল। বালক হলে কী হবে, বেশ বড়োদের মতো হাবভাব — জিনসের প্যান্ট, জুতোমোজা, মাথায় টুপি, চোখে গগলস। হাতে তার বেশ বড়ো সড়ো স্যুটকেস। বাচ্চা মেয়ে দুটো আমাদের পাশে এসে বসল।
একজনের পরনে বেগুনি ফ্রক, চোখের পাতায় আর ঠোঁটে বেগুনি রঙ লাগানো, অন্যজনের গোলাপি ফ্রকের সাথে রং মিলিয়ে চোখের পাতার ওপর আর ঠোঁটে গোলাপি। দুজনের হাতে সাদা ব্যাগ। ব্যাগের মধ্যে থেকে জামাকাপড় উঁকি দিচ্ছে। দুজনেরই পায়ে সোনালি রূপালি জরি দেওয়া চটি। কানে সাদা পুঁতির দুল। হাতে ‘বুয়ার করা’ মেহেন্দির নকশা। না বাঁধা ঘাড় অবধি লম্বা চুল হাওয়ায় উড়ছে। মুখে অনাবিল হাসি লেগে আছে।
খিদে পেয়েছিল। তেষ্টাও। ঘন্টাখানেকের বেশি বাসে চেপেছি। পেটে কিছু পড়েনি সকাল থেকে। কাঁধের ঝোলা ব্যাগ থেকে বিস্কুটের প্যাকেট আর জল বের করলাম। বাচ্চাগুলোকে বিস্কুট দিতে গেলাম। প্রথমে না না করে তারপর রাজি হয়ে গেল। এর আগে অবশ্য আমার পাশে বসা বেগুনি ফ্রকের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে নিয়েছি। ওর নাম রেশমা। ওর কাছ থেকে জানলাম, গোলাপি ফ্রকের নাম নাসরিন। ওরা দুই বোন, আর সঙ্গে ওদের একমাত্র গার্জেন যে গগলস পরা বালক, সে ওদের ভাই। ভাই মানে বড়ো ভাই। যদিও সে পড়ে ক্লাস থ্রিতে আর বোনেরা পড়ে ক্লাস ফোরে। স্কুলের নাম অবশ্য ঠিক বলতে পারল না। বলল, পাইমারি স্কুলে পড়ে। পুরো নাম কী, পাইমারির আগে কী, সে ঠিক মনে নাই। তবে সব প্রশ্নের উত্তরেই দারুণ হাসে রেশমা। যাচ্ছে ওরা নানির বাড়ি ‘ঘোড়াদায়’। থাকবে পাঁচদিন। আমরা বললাম, এত সাজগোজ কেন — গান না নাচ হবে? রেশমা বলল, নাচব। বোন নাসরিন বিস্কুট দুটো খেতে না পেরে দেড়খানা দিদির কাছে ফেরত দিল। সেগুলো সব সাদা থলের ব্যাগে জামাকাপড়ের ভাঁজে সে রেখে দিল।
ওদেরকে টাটা করে মুন্সীর হাটে এসে চাপলাম ট্রেকারে। ট্রেকারে আবার আমাদের সঙ্গে তিনটে বাচ্চা। এবারও দুটো মেয়ে একটা ছেলে। তবে, এরা আরো ছোটো। সঙ্গে দুই মা কালো বোরখা গায়ে। সবকটা বাচ্চার বয়স পাঁচ থেকে সাত। আমাদের কোলের সামনে কে কোথায় দাঁড়াবে, তা নিয়ে খুব হুজ্জোতি করছে। সবচেয়ে ছোটো মেয়েটা খুব ছটফটে। আমার পাশে তার মায়ের কোলের সামনে দাঁড়াবে, নাকি ডানদিকে ঘেঁষে যেদিকে রাস্তা দেখা যাবে, সেদিকে দাঁড়াবে, কিছুতেই ঠিক করতে পারছে না। দাদা-দিদির সঙ্গে ঝগড়া করছে। মার কাছে বকা খেয়েও থামে না। ওদিকে অন্য একটা বাচ্চাকে জল খেতে দেখে তার মনে পড়ে গেল, তারও তেষ্টা পেয়েছে। মায়ের কাছে পানি চাইতে, মা বলল, পানি নেই, এই তো একটু পরে খাবি। আমি ব্যাগ থেকে জলের বোতল বার করে বললাম, পানি খাবে? সে অনেকটা ঘাড় কাৎ করে, ছোটো মুখ হাঁ করল, কচি গালে জল ঢেলে দিলাম। সে দুবার চেয়ে খেল। এর নাম আনিকি। এর সঙ্গে যাচ্ছে এর পিসতুতো বোন আসিকি। সেও একটু পানি চেয়ে খেল। রোদ চড়ছে। বাচ্চারা হৈ হৈ করে রাস্তা দেখতে দেখতে যাচ্ছে। কে বলল, ওই দ্যাখ একটা মেয়েছেলে বাইক চালাচ্ছে। সত্যিই সামনে এক মহিলা শাড়ি পরে স্কুটার চালিয়ে যাচ্ছেন। দেখে কী হাসি।
তারপর রাস্তা চলেছে ট্রেন লাইনের সমান্তরাল। ‘ট্রেন লাইন’ ‘ট্রেন লাইন’ বলে চেঁচিয়ে লাফিয়ে আসিকি ও আনিকির কী উত্তেজনা। মা ও পিসি বলল, চল্ মল্লিকবাড়ি থেকে ট্রেনে চাপাব। জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাচ্ছ? বাচ্চারা বলল, নানার বাড়ি। ওখান থেকে ট্রেনে চেপে আমরা কুটুম বাড়ি যাব। আমরা বললাম, আমরাও সঙ্গে যাব। বাচ্চাগুলো হেসে হেসে ঘাড় নেড়ে বলল, ‘না না’। আমরা বললাম, যাবই, আমরা জানি ওখানে ভালো খাওয়াদাওয়া হবে। আজ সবাই নানা নানির বাড়ি যাচ্ছে। এর আগের বাসে একদলকে দেখেছি। এবার সবাই হাসতে লাগল — বাচ্চারা, তাদের মায়েরাও। এর মধ্যেই আমাদের গন্তব্য এসে গেল — মাজু। নামার সময় দেখি, ওরা তখনও হাসছে।
দিদির অসুখ সারছে না শুনে মন খারাপ নিয়ে রওনা দিয়েছিলাম। তার অনেকটাই কমে গেল রাস্তায় বাচ্চাগুলোর সঙ্গে চলতে চলতে।
অমিতাভ সেন, কলকাতা, ১৫ এপ্রিল
Leave a Reply