নিরন্তর নিরীক্ষা
ভিজিলেন্স বলে ইংরাজিতে একটা কথা আছে যার অর্থ হল নিরন্তর নিরীক্ষা। এর মানে প্রসবকালীন জননীর জন্য নির্দিষ্ট একজন কাউকে দায়িত্ব নিতে হবে। অবশ্যই তাকে নিবিড় সেবায় নিবেদিত প্রাণ হতে হবে — এটাই সবচেয়ে দরকারি, তা সে প্রসবের কাজে দক্ষ বা অদক্ষ যাই হোক না কেন। যদি বাড়িতে প্রসব হয় তাহলে পরিবারের কেউ না কেউ কাছাকাছি থাকলে প্রসূতি মানসিক বল পায়। তাছাড়া আপৎকালীন ব্যবস্থার জন্য সে ছুটোছুটি করতে পারবে।
কোনো প্রসবেই সব ঠিকঠাক হবে সেটা জোর দিয়ে আশ্বাস দেওয়া যায় না। তাহলে অতীতে কী হত? বহু মা ও শিশু অকালে জীবন হারাত। এর কোন পরিসংখ্যান তৈরি হয়নি; সবই ভাগ্যের ফল বলে সবাই মেনে নিয়েছে। বাড়িতে কমবয়সি কেউ গর্ভবতী থাকলে বাড়ির বড়োরা ভয়ে ভয়ে থাকতেন; কত কথা ছিল ‘বাবা, ভালোয় ভালোয় যেন সব হয়ে যায়, মা-বাচ্চা সুস্থ থাকে যেন’।
একটা ছোটো ঘটনা বলি। সুন্দরবনের একটা দ্বীপে বছর কয়েক আগে একটা স্বাস্থ্য শিবিরের কাজে গিয়েছি। গৃহস্থ কর্তা বলছেন, ‘আমার বউটার প্রসব বেদনা উঠেছে, রাত হয়ে আসছে, ভয়ে ভয়ে থাকি — হয় পোয়াতি মরবে নয়তো বাচ্চাটা মরবে। গ্রামে হ্যারিকেন বাতি। ডাক্তারবাবু রাতে থাকেন না। একমাত্র ভরসা দাইমা।
বেগতিক হলে যদি কাছের কোনো হাসপাতালে যেতে হয় ওই ভুটভুটিই একমাত্র ভরসা। কিন্তু সেটাও পাওয়া মুশকিল। আবার পেলেও সমস্যা — ভাড়া পড়বে ৩৫০০ টাকা। এত খরচ কী করে করব’?
আর একটু বর্ধিষ্ণু জায়গায় বলল, দুটো স্পিডবোট সর্বক্ষণের জন্য থাকলে গোটা গ্রামকেই সাহায্য করা যাবে। কথাটা সত্য। তবে স্পিডবোট যদি হয় তবে তো? তাছাড়া যেমন করেই হোক যদি আরও বড়ো হাসপাতালে পৌঁছানো যায়, তবুও শেষরক্ষা হয় না। কারণ এই মৃত্যু ডাক্তারদের পক্ষেও এড়ানো সম্ভব নয়। ‘রেফারেল সিস্টেম’ আছে, তবে বহু দূরে পাঠালে কী হবে? কিছু জায়গায় অনেক ডাক্তারদের দক্ষতার অভাব আছে, সেই জন্য তারা আপৎকালীন সিদ্ধান্ত নিতে সাহস পান না। তাঁরা ভাবনায় থাকেন — কিছু গণ্ডগোল হলে মার খাবেন।
মা এবং শিশুদের জন্মাবার আগে বাড়ি গিয়ে দেখা, আলোচনা করা ও ক্লিনিকে যাওয়ার কথা বলা হয়। এর জন্য অনেক স্তরে অনেক লোক রাখা আছে। যেমন, এএনএম, আইসিডিএস, দাই, পঞ্চায়েত কর্মী, ‘আশা’, স্বাস্থ্য পরিদর্শক ও এনজিও-র কর্মীরা। তবে যতটা কাজ হওয়া উচিত, হয়নি। কারণ এরকম অনুৎপাদনশীল ক্ষেত্রে সময় কে কতটা দিচ্ছে তার সমীক্ষা করা কঠিন। তবে কাজ যে ঠিক মতো হচ্ছে না, তা তো বোঝাই যাচ্ছে পোলিও-প্রতিষেধক-কর্মসূচি এখনও সম্পূর্ণ করা যায়নি দেখেই। প্রসবকালীন জননীর মৃত্যু হয়তো সামান্য কমেছে। কিন্তু বেমানান পরিকল্পনা ও প্রয়োগের জন্য আশানুরূপ ফল মিলছে না। চলবে
প্রসূতি ও সদ্যোজাত শিশুর পরিচর্যা, পরিষেবা ও পুষ্টি বিষয়ে একজন অভিজ্ঞ ধাত্রীবিদ্যা-বিশারদের কিছু মতামত
Leave a Reply