চূর্ণী ভৌমিক, শান্তিনিকেতন, ২৭ ডিসেম্বর#
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে গেলে আমার তো সব গুলিয়ে যায়। আসলে এত বড়ো এত ছড়ানোছিটানো এতটাই খোলামেলা যে বাইরের থেকে ভেতরকে আলাদা করে এক ঝলকে চেনাই শক্ত। কয়েকদিন আগেই ওখানে গেছিলাম, কাজের ছুতোয় ঘুরতে। আমি আর আমার দুই বন্ধু মিলে — শীলু এবং রিষা।
বিশ্বভারতীতে গত কয়েকমাসে তো অনেকগুলো বড়োসড়ো ঘটনা ঘটে গেছে যা আমাদের খবরের কাগজগুলোতে এবং ফেসবুকের মতো সোশাল মিডিয়াতে জায়গা পায়। তার মধ্যে যে ঘটনাটা আমাদের সবচেয়ে বেশি বিচলিত করে সেটা হল কলাভবনের প্রথম বর্ষের ছাত্রীর শ্লীলতাহানি এবং তার বাড়ি চলে যেতে বাধ্য হওয়ার ঘটনা। আমরা ঠিক করি যে ক্যাম্পাসের ছাত্রছাত্রীদের জিজ্ঞাসা করব তারা এই বিষয়ে কী জানে, কী ভাবে। সোশিওলজির ছাত্রী রিষা পুরো উদ্যমে বিভিন্ন ছাত্রছাত্রীদের ডেকে কথা বলতে শুরু করে। সব মিলিয়ে আমরা প্রায় ১০-১২ জনের সঙ্গে কথা বলি। নন্দন মেলা, পাঁচিল তোলা এমনকী র্যাগিং নিয়েও কথাবার্তা হয়। শুধু ওই বিশেষ ঘটনাটি সকলেই এড়িয়ে যেতে থাকে। একজন বলে যে এ বিষয়ে কথা বলা মানা। তারপর বলে যে আদতে তারা বাইরের লোকজনদের এ বিষয়ে কিছু বলবে না। কেউ কেউ এত সরাসরি না বলে — আমি তো ছিলাম না তাই আমি ঠিক জানি না — বলে এড়িয়ে গেল। কেউ কেউ বলল যে মেয়েটির ওটা একটা ব্যক্তিগত সমস্যা ছিল।
প্রথমেই বলেছিলাম, বিশ্বভারতীর বাইরে এবং ভেতরটা আলাদা করতে অসুবিধা হয় আমার। এবার আর সেটা হচ্ছিল না, নিজেকে বেশ বহিরাগত একজন অবাঞ্ছিত ‘বাইরের লোক’ মনে হচ্ছিল।
এরপর বিকেলবেলা এক কলেজের বন্ধুর কাছ থেকে নম্বর পেলাম একটি ছেলের। সে নাকি আমাদের গোটা বিষয়টা বুঝিয়ে বলতে পারবে। তার সাথে যোগাযোগ হল। বিশ্বভারতীরই ছাত্র। সে এবং তার জনা ৫-৭ বন্ধুর সঙ্গে আমরা তিনজন একটা চায়ের দোকানে গিয়ে উঠলাম। সঙ্গে ছিল মৈত্রেয়ী। ও কলাভবনের ছাত্রী এবং মেয়েটি ওর বন্ধু ছিল।
তারপর শুরু হল আলোচনা, ভিসির বিরুদ্ধে এবং সংরক্ষণ তুলে নেওয়ার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়েছে সে বিষয়ে অনেক কথা বলল ওরা। তারপর আমরা যখন মেয়েটির ঘটনাটা জানতে চাইলাম তখন এই আমাদেরই বয়সী ছেলেমেয়েগুলোর কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। তাদের বিষয়টা নিয়ে কোনো তাপ-উত্তাপই নেই। একটি মেয়ে তো প্রচণ্ড হেসে হাত মুখ ঘুরিয়ে বলতে শুরু করল যে বিষয়টা খুবই গোলমেলে, কারণ হল, ১। মেয়েটি স্বেচ্ছায় ছেলেগুলোর সঙ্গে মিশত ২। মেয়েটি একাধিক আলাদা আলাদা বয়ান দিয়েছিল ৩। কোপাইয়ের ধারে ফ্ল্যাশ দিয়ে ছবি তুললে বাকি লোকজনেরা তো দেখতে পাবে, তাহলে সেটা কী করে সম্ভব?
সহমর্মিতার অভাব দেখে হকচকিয়ে গেলাম। একটা বাচ্চা মেয়ে, তাও অন্য ভাষাগোষ্ঠীর, অত দূর থেকে পড়তে এসেছিল। তার সঙ্গে অন্যায় হয়েছে এবং সে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে। তারপরেও এত অমানবিক কথাবার্তা শুনে রাগ হচ্ছিল। এরাও শেষমেশ বলল যে ঘটনাটা একটা ‘বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিগত’ ঘটনা। এমনকী কথা প্রসঙ্গে নর্থ-ইস্টের ছেলেমেয়েদের সম্বন্ধে বেশ বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাবই প্রকাশ পেল।
Leave a Reply