১০ আগস্ট, আকতারুল হোসেন মল্লিক, থানারপাড়া গ্রাম, নদিয়া#
মোটরভ্যানে গরু পাচারের ছবিগুলি প্রতিবেদকের মোবাইলে তোলা।
নদিয়ার করিমপুর ২নং ব্লকের থানারপাড়া থানার সামনে দিয়ে প্রতিদিন শত শত গরু পাচার হচ্ছে। লরিতে করে গরু নিয়ে পণ্ডিতপুর গ্রাম হয়ে দোগাছি গ্রামের মধ্য দিয়ে করিমপুর (?) হয়ে বাংলাদেশ পার হয়ে যাচ্ছে। এই থানারপাড়া থানার এলাকার মধ্যেই নতিডাঙা ১নং গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে আমাদের ব্লকের হাসপাতাল আছে, উচ্চমাধ্যমিক স্কুল আছে। ওখানে লরিগুলো দাঁড় করিয়ে টাকা তোলা হয়। এটা বাধা দিতে গেলে পঞ্চায়েত প্রধানকে মারধোর করে, অপমান করে। তাতে প্রধান ৯ জুন ২০১১ তারিখে একটা কেস করে। এই কেস করার পরেও আসামীদের গ্রেপ্তার করা হয়নি, গরু পাচার বন্ধও হয়নি। তখন আমরা ওই থানার ওসিকে দায়ী করে প্রচুর মানুষের স্বাক্ষর সংগ্রহ করি। নদিয়ার জেলাশাসক ও সুপারিন্টেন্ডেন্ট অফ পুলিশ, সিআই-করিমপুর সার্কেল এবং নতিডাঙা ১ ও ২নং পঞ্চায়েত প্রধানদের কাছে আমরা একটা মাস-পিটিশন দিই। এতেও অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। মাস-পিটিশন দিতে যখন সিআই-এর কাছে গিয়েছিলাম, তিনি বলেছিলেন, আমরা এতদূর থেকে গাড়িগুলো আটকাতে পারি না। আপনারা গ্রামের মানুষ গাড়িগুলো আটকে দিয়ে আমাদের খবর দিন, আমরা ব্যবস্থা নেব। আমি ২৮ আগস্ট ২০১১ সকাল দশটার সময় থানারপুর থানার ওসিকে আমি ফোন করে বিষয়টা বলি। তিনি আমাকে প্রাণে মেরে দেওয়ার সরাসরি হুমকি দেন। আমি হুমকি পেয়ে আর দশ মিনিটও অপেক্ষা করিনি। দেবগ্রামে আমার পরিচিত এক আইনজ্ঞের কাছে চলে আসি। তাঁর পরামর্শ নিয়ে সেখান থেকে চলে আসি কলকাতায়। কলকাতায় কয়েকজন বন্ধুর সাহায্য নিয়ে ই-মেল করে ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশন, স্বরাষ্ট্র সচিব, রাজ্যপাল, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পুরো বিষয়টা জানাই। স্থানীয় যারা প্রতিবাদে শামিল হয়েছিল, আমার চলে আসার পর তারা যখন ঘটনাটা জানতে পারে, তারা ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। ওইদিনই তারা করিমপুর থেকে সিকি কিলোমিটার দূরত্বে গোমাখালিতে একটা গরু বোঝাই গাড়ি দাঁড় করিয়ে দেয়। আমি কলকাতায় তৎক্ষণাৎ খবরটা পেয়ে যাই এবং রাত ১২টা ১৭ মিনিটে সিআই-কে ফোন করি। সিআই বলেন, ‘আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি’। পরক্ষণেই আমার কাছে একটা ফোন আসে। থানারপাড়ার পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রতিবাদী মানুষকে মারধোর করে গরু বোঝাই গাড়িটাকে পার করিয়ে দিয়েছে আর সঙ্গে সঙ্গে ওখান থেকে একটা মোটর সাইকেল, মোবাইল আর দু-হাজার টাকা কেড়ে নিয়েছে। আমাদের বিরুদ্ধে একটা কেসও থানাতে রুজু করা হয়।
পরদিনই কিছু করা দরকার। সেই মতো আট-দশজন থানারপাড়া থেকে কলকাতায় চলে আসে। আমি তো আগের দিন থেকেই ছিলাম। আমি ই-মেল করে যেগুলো পাঠিয়েছিলাম, সেগুলোর কপি রাজভবন, রাইটার্সে গিয়ে রিসিভ করিয়ে নিই। রাইটার্সে একজন ব্যক্তি আমাকে বলেন, ‘আপনি কালিঘাটে চলে যান এবং মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আপনার কতাহগুলো বলুন। হয়তো কিছু হতে পারে।’ পরদিন আমরা কালিঘাটে গেলাম। সবাইকে ওখানে ঢুকতে দিল না। ওখানে আমাকে বলল, আপনি বাংলায় লিখুন আপনার বক্তব্য। আমি বাংলায় ঘটনাটা লিখলাম। মুখ্যমন্ত্রীর স্পেশাল ডিউটি অফিসার এ সি চক্রবর্তীর সঙ্গে আমার কথা হয়। তিনি আমাদের আশ্বস্ত করলেন, ঠিক আছে, আপনারা ফিরে যান। আপনাদের জবাব দেওয়া হবে। তবু আমার আতঙ্ক কাটে না। আমি বাড়ি না ফিরে কলকাতাতেই আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে সবাই মিলে অপেক্ষা করি। আনুমানিক দুপুর তিনটের সময় মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি থেকে আমাকে ফোন করা হয়। ফোনে আমাকে জানানো হল, ওরা এসপি-র সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তাতে জেনেছেন, এটা একটা ফল্স কেস। আমরা যেন এসপি-র সঙ্গে কথা বলি। আমাদের নিরাপত্তা দেওয়া হবে। আপনারা বাড়ি চলে যান।
পরদিন ছিল ঈদ। আমি বাড়ির দিকে রোনা হই। পথেই জানতে পারি, থানার ওসি আমার বাড়িতে গিয়ে হেনস্থা করছেন এবং ভয় দেখাচ্ছেন। আমি ভয়ে আবার কলকাতায় ফিরে আসি। পরদিন কলকাতাতেই ঈদের নামাজ পড়ি। পরদিন আবার কালিঘাটে যাই। ওরা বলেন, আপনি এসপি-র সঙ্গে দেখা করুন। আমি কৃষ্ণনগরে গিয়ে এসপি-র সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। আমি বলি, আমাদের বিরুদ্ধে ফল্স কেস তুলতে হবে; মোটর সাইকেল ফেরত দিতে হবে এবং থানার আধিকারিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি আমাকে আশ্বস্ত করেন। আমি গ্রামে ফিরে আসি।
মাসের পর মাস কেটে গেল। কোনো ধরপাকড় হল না। মোটর সাইকেলও ফেরত দেওয়া হল না। কেসও তোলা হল না। আমি আবার বেশ কয়েকবার এসপি-কে ফোন করি। বিভিন্ন সরকারি মহলে যেতে থাকি। মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে চিঠিও আসে। সেখানে বলা হয়েছে যে তদন্ত রিপোর্ট আমাকে দেওয়া হোক। সিআই যে রিপোর্ট করেছেন সেটা ফল্স রিপোর্ট — এফআইআর ও চার্জশিটে আকতারুল হোসেন মল্লিকের নাম আছে। কিন্তু আমার কাছে ওগুলোর সার্টিফায়েড কপি আছে, তাতে আমার নাম নেই। গোমাখালি থেকে যে মোটর সাইকেলটা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, সেটা আনক্লেমড প্রপার্টি হিসেবে দেখানো হয়েছিল। আর ওটা নাকি চুনাখালি থেকে আনা হয়েছে। সেটার জন্য দুটো জিডি নাম্বার। কেসে একবার বলা হয়েছে, পানাগড় থেকে আমি আম ও কলা লোড করে দিয়েছিলাম লরিতে। আর একবার লিখেছে, পানাগড় থেকে আম ও কলা লোড করে ফিরছিলাম। ১১২ নং কেসে তিনটে এফআইআরে তিনরকম ভাষা! আমরা জেলাশাসকের কাছে সমস্ত তথ্য দিয়ে জানালাম, গোটা রিপোর্টটাই ভুয়ো। পরবর্তীকালে তিনি এসপি-র মাধ্যমে আমাকে যে রিপোর্ট পাঠালেন, সেটা মোদ্দা একই রিপোর্ট।
দু-বছর পার হয়ে গেছে, প্রশাসনের কাছ থেকে আমরা কোনো সুরাহা পাইনি। তাই আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি। এই মুহূর্তে গরু পাচার বন্ধ নেই। শুধু ধরনটা কিছু পাল্টিয়েছে। ভারী ভারী লরি বন্ধ হয়েছে, কিন্তু ম্যাটাডোর এবং ইঞ্জিন-চালিত ভ্যানে গরু পাচার চলছে। গরুগুলোকে বেঁধে গাদাগাদি করে নিয়ে যাওয়া হয়। এটা মর্মান্তিক। এই লরিগুলো ভোরের দিকে এত বেপরোয়াভাবে চলত, আমাদের ওখানে চাপা পড়ে একজনের মৃত্যুও হয়েছে। দোগাছি কালিতলা ঘাট পার হয়ে মুর্শিদাবাদ পড়ছে। গরুর চাপে নৌকায় ছাত্রছাত্রী স্কুলে যাওয়াআসা করতে পারত না। তারা ওই ঘটনায় প্রতিবাদ করে। লরির জন্য মাটির ঘর ও রাস্তার ক্ষতি হয়। তাছাড়া যেখানে সেখানে পাহাড়ের মতো উঁচু করে বিচালি ফেলা হয়, সেগুলো পচে দুর্গন্ধ ছড়ায়। মুর্শিদাবাদের এসপি বদলি হওয়ার পরে অনেকসময় মুর্শিদাবাদ না হয়ে গরু বনগা সীমান্ত দিয়ে যাচ্ছে।
হাগনাগারি গরুর হাট থেকে গরুগুলো লোড করে নেওয়া হয়। যেটা আমাদের প্রশ্ন, বাংলাদেশে গরু পাচার দেখার দায়িত্ব বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের। অথচ এপারে গ্রামের সাধারণ মানুষ যখন চাষের জন্য বা নিজেদের প্রয়োজনে গরু কিনে নিয়ে যায়, পুলিশ তাদের হেনস্থা করে এবং টাকা নেয়। বাংলাদেশে গরু পাচার আগেও হত। তবে গত পাঁচ-সাত বছর, বিশেষত বছর তিনেক ব্যাপকভাবে বেড়েছে।
Leave a Reply