২৫ ফেব্রুয়ারি, জিতেন নন্দী#
দুনিয়া সে মুহ মোড় লিয়া ম্যায়
তুঝসে নাতা জোড় লিয়া হ্যায়।
মোহে অপনে হী রঙ মে রঙ দে নিজাম।
নিজামউদ্দিন ওয়ালিয়া তু পীর মেরা
মোরি লাজ শরম সব রাখ দে নিজাম।
মোহে অপনে হী রঙ মে রঙ দে নিজাম।
দিল্লিতে এক কাশ্মীরি খাবারের দোকানের মালিকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল একদিন দুপুরে। তিনি একজন কাশ্মীরি পণ্ডিত। কথায় কথায় বললেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নিজামউদ্দিন আউলিয়ার দরগায় গেলে চমৎকার কাওয়ালি শুনতে পাবেন। আমি সেই লোভে একদিন করোলবাগ থেকে নিজামউদ্দিন স্টেশনগামী বাসে চেপে পৌঁছে গেলাম দরগায়।
তখন সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেছে। আমি ভাবছি, বেশ দেরি হয়ে গেল। বড়ো রাস্তা থেকে দরগায় যাওয়ার পথের দু-ধারে প্রচুর দোকানপাট। ফলের দোকান, হোটেল, কাবাবের দোকান, নানারকম তন্দুরি রুটির দোকান, শুকনো খেজুরের দোকান পেরোলাম। এরপর সারি সারি ফুল আর মালা সাজানো ডালার দোকান। ঠিক যেমন কালিঘাটের মন্দিরে ডালা সাজিয়ে দর্শনার্থীদের ডাকা হয়, এখানেও প্রতিটি দোকান থেকে ডালা কেনার জন্য ডাকা হচ্ছে, জুতো দোকানে খুলে দরগায় যাওয়ার জন্য বলা হচ্ছে। ডালায় রয়েছে ফুল, মূলত গোলাপ ফুল। এছাড়া ধূপ, আতর, রঙ ইত্যাদিও রয়েছে। কয়েকটা হোটেল গোছের রয়েছে, সেখান থেকে কাগজের একটা স্লিপ হাতে ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিয়ে স্লিপটা কিনলে সেই টাকায় গরিবদের খাওয়ানো হবে। ধারণাটা হল, গরিবদের খাওয়ালে পূণ্য হবে। আমি এইসব দোকানিদের পাশ কাটিয়ে দরগায় গিয়ে উঠলাম। দরগায় নিজামউদ্দিন ওয়ালিয়ার সমাধিতে ডালা চড়াতে তো আমি আসিনি। তবে জুতো জোড়া একটা দোকানে রাখতে হল।
দরগার চারপাশে একটা বড়ো চত্বর। একপাশে শতরঞ্চির ওপর বেশ কিছু মহিলা বসে আছে। তাদের সঙ্গে বাচ্চাকাচ্চা রয়েছে। আর কিছু লোক ডালা হাতে দরগায় ঢুকছে। দলে দলে মানুষ দরগায় এসে উপস্থিত হচ্ছে। তাদের প্রায় সকলেই মুসলমান। তবে চেহারা আর বেশভুষা বৈচিত্র্যপূর্ণ। বোঝা যায়, এরা বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আসছে। সমাধির ঘরটার বাইরে লেখা রয়েছে, মহিলাদের প্রবেশ নিষেধ। সুন্দর কারুকার্য করা থামগুলোর গায়ে হেলান দিয়ে দাড়িওয়ালা সুপুরুষ মৌলবি গোছের কিছু মানুষ বসে রয়েছে। তখন আজান হচ্ছে, … নামাজ হবে। আমি একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, কাওয়ালি কখন হবে? তিনি বললেন, কাওয়ালি তো সারাদিনই চলছে। কে শুনতে চায়? এখন শুরু হতে দেরি আছে। আমি দেখলাম, রাত ন-টার পরে যদি শুরু হয়, তাহলে আমার ফিরতে বেশ রাত হয়ে যাবে। সেদিন ফিরে এলাম।
শেখ নিজামউদ্দিনের জন্ম হয়েছিল উত্তরপ্রদেশের বুদাউন জেলায় ১২৩৬ সালে। বুদাউন সুফি-সন্ত-আউলিয়াদের জন্য বিখ্যাত। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বাবা মারা যাওয়ার পর শিশু নিজামউদ্দিন মায়ের হাত ধরে দিল্লিতে আসেন। এখানেই সন্ত শেখ ফরিদ শাকারগঞ্জের কাছে তিনি শিষ্যত্ব লাভ করেন। হজরত নিজামউদ্দিনের মৃত্যু হয় ১৩২৫ সালে। প্রকৃতপক্ষে তাঁর সমাধির অস্তিত্ব আর নেই। ফিরোজ শাহ তুঘলক (১৩৫১-৮৮) সেই সমাধি-সৌধ মেরামত করলেও পরে তা অবলুপ্ত হয়। এরপর ১৫৬২-৬৩ সালে বর্তমান কাঠামোটা গড়েন ফরিদুঁ খান নামে এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। দরগার পশ্চিমে রয়েছে মেয়েদের আলাদা মসজিদ, জামাত-খানা মসজিদ। এখানেও রয়েছে অন্যান্য সৌধের মতোই কয়েকতলা বিশাল কুয়ো বা বাওলি। দর্শনার্থীরা এর জলকে পবিত্র বলে মনে করে।
ক-দিন পরে দুপুরবেলা আবার দরগায় এলাম। দেখি, দরগার সামনের চত্বরে কাওয়ালি গাইছেন কাওয়ালদের একটা দল। হারমোনিয়াম আর ঢোল বাজিয়ে কিছুটা ভাঙা গলায় গান গেয়ে চলেছেন ওস্তাদ। সঙ্গে ধুয়ো দিচ্ছে সহ-গায়কেরা। এক-একজন এসে হারমোনিয়ামের সামনে দশ টাকার নোট রেখে যাচ্ছে। দুটো গান গাওয়ার পর তাদের যন্ত্র সঙ্গে নিয়ে তারা উঠে যেতেই আরেকটা দল এসে গান ধরল। দরগার মুখের দিকটা খোলা রেখে দুদিকে কিছু লোক এসে গান শোনার জন্য বসে যাচ্ছে। তবে আমার মতো একটানা কেউ শুনছে না। মোট গোটা পাঁচেক কাওয়ালি শোনার পর আমিও উঠলাম। সব গানেই রয়েছে দেবতার বন্দনা। তবে গানের মধ্যে ভক্তি বা প্রেমের মূর্ছনার অভাব রয়েছে, কিছুটা নিষ্প্রাণ। আমার মনের মধ্যে বাজছিল নুসরত ফতেহ আলির উদাত্ত কাওয়ালির আহ্বান : দুনিয়া থেকে আমি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি, তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক জুড়েছি। প্রভু, আমায় তোমারই রঙে রাঙিয়ে নাও/নিজামউদ্দিন আওলিয়া তুমি আমার পীর, প্রভু রেখে দাও আমার লজ্জাশরম সব, আমায় তোমারই রঙে রাঙিয়ে নাও প্রভু।
Leave a Reply