কাদের চৌধুরি, মুর্শিদাবাদ, ১৫ নভেম্বর#
এলাকার প্রভাবশালী বিত্তশালী ক্ষমতাশালী, বাসুদেবপুরের দু-দুটো দেশি ও বিদেশি মদের দোকানের মালিক, আগে ফরওয়ার্ড ব্লক অধুনা তৃণমূল নেতা জগন্নাথ চৌধুরি যখন বছর দুয়েক আগে জঙ্গীপুরে এলাকা ঘিরলেন বছর দুই আগে, লোকে বুঝে গেল, একটা মদ ফ্যাক্টরি হতে চলেছে। জগন্নাথ যতই বলুন জলের বটলিং প্ল্যান্ট করা হবে, এলাকার মানুষ এবং বুদ্ধিজীবীরা তা বিশ্বাস করল না। তারপর আরটিআই করে জানা গেল, মদের ফ্যাক্টরির লাইসেন্স যারা দেয়, সেই এক্সাইজ ডিপার্টমেন্ট থেকে লেটার অব ইন্টেন্ট পর্যন্ত জোগাড় হয়ে গেছে। কিন্তু বটলিং প্ল্যান্টের জন্য কোনো লাইসেন্স জোগাড় হয়নি। লোকের বুঝতে আর সমস্যা রইল না। এলাকার বুদ্ধিজীবী মানুষরা তৈরি করল ‘নাগরিক অধিকার সুরক্ষা মঞ্চ’ — হিন্দু মুসলিম সবাইকে নিয়ে। সভাপতি ও সম্পাদক হলেন গাজিনগর হাইমাদ্রাসার শিক্ষক নুরুল ইসলাম ফাইজি সাহেব এবং হাইস্কুল শিক্ষক আবদুল ওয়াহাব সাহেব। ভাইস প্রেসিডেন্ট হলেন তারাপুরের বিড়ি শ্রমিক অধ্যুষিত অঞ্চলের ফার্মাসির আখতার হোসেন সাহেব। গত বছর রোজার মাসে ডাকবাংলো মোড়ে বিডিও অফিসে গিয়ে হাজার লোক ডেপুটেশন দিয়ে এল, এই মদ ফ্যাক্টরি যেন না হয়। বিডিও বললেন, ওটা কর্তৃপক্ষকে ফরোয়ার্ড করে দেবেন।
এই জগন্নাথ চৌধুরির দেশি ও বিদেশি মদের খুচরো দোকান থেকে হোলসেল মদ বিক্রিও হত, জঙ্গীপুরের বিভিন্ন গ্রামে ঠেক বসত এই সরবরাহের ওপর ভিত্তি করে। স্কুলে যাওয়া ছেলে মেয়েদের কাছে ভয়ের ব্যাপার হয়ে উঠেছিল এইসব ঠেক। ফলে গ্রামবাসীরাও খাপ্পা হয়ে যায় এই মদ সরবরাহের কাজকারবারের প্রতি। গ্রামবাসীরা সরবরাহকারীদের হাতেনাতে ধরে এবং এক্সাইজ ডিপার্টমেন্টের হাতে তুলে দেয়। আপাত দৃষ্টিতে এক্সাইজ বিভাগ গা এড়িয়ে যায়। কিন্তু তারা তাদের গোপন রিপোর্টে জেলাশাসক ও এক্সাইজ কমিশনারের কাছে এই মদের কারবার ও মদের রিটেল দোকান দুটি বন্ধ করে দেওয়ার সুপারিশ জানায়। তৎকালীন থানার ওসি-ও এই মদের দোকানগুলির জন্য এলাকার শান্তিশৃঙ্খলা লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে রিপোর্ট দেন। কিন্তু বর্তমান শাসকদলের একটি লবির নেতা হওয়ার কারণে তাঁর কিছুই হয়নি। জগন্নাথের ছেলে সুনীলও জেলার যুব তৃণমূল নেতা। তাই এমনকী পার্টিও এঁদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেয়নি।
জগন্নাথের ক্ষমতা এবং তার অপরাধের পূর্বনমুনা থাকার কারণে নাগরিক অধিকার সুরক্ষা মঞ্চ এসডিপিও-র কাছে সুরক্ষা চেয়েছিল এইবছর রোজা কেটে যাওয়ার পর। এরপর ওই মদের ফ্যাক্টরি বন্ধ এবং এলাকার মদের কারবার বন্ধের দাবিতে ১৫ নভেম্বর একটি ধরনার জন্য প্রশাসনের কাছে অনুমতি চেয়েছিল মঞ্চ। কিন্তু এসপি অনুমতি দিতে অস্বীকার করেন। তখন ঠিক হয়, বিনা অনুমতিতেই ধরনা হবে, যেহেতু ধরনার জোগাড়যন্তর করা হয়ে গিয়েছে। ১০ তারিখে সুনীল চৌধুরি জগন্নাথ চৌধুরিপন্থী তৃণমুল নেতারা প্রকাশ্য সভা করে জানায়, যেভাবে হোক তারা ১৫ নভেম্বরের ধরনা রুখবেই। ওই ১০ নভেম্বর তারিখেই রাত পৌনে এগারোটায় পুলিশ আখতার হোসেনের বাড়িতে ফোন করে জানায়, ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের ওপর চার লেনের যে লেনটি বন্ধ, সেখানে আখতারের দেহ পড়ে রয়েছে। মনে হচ্ছে অ্যাকসিডেন্ট। আখতার সাহেব তখন তাঁর ফার্মেসি থেকে ফিরছিলেন। তারাপুর হাসপাতালে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে মৃত্যু হয়। পরদিন ভোরবেলা মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই শয়ে শয়ে লোক জড়ো হয়ে যায় হাসপাতালের সামনে। পুলিশ মৃতদেহ সরিয়ে নিতে চাইলে জনতা বাধা দেয়। পুলিশ অভিযোগ করে, তাদের আক্রমণ করা হয়েছে এবং সাইফুদ্দিন, আবদুল ওয়াহাব, রফিকুল ইসলাম সহ ৬ জনের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। জনতা মৃতদেহ নিয়ে ‘দুর্ঘটনা’ স্থলে এসে বিক্ষোভ দেখাতে থাকে। আখতারের পরিবারের পক্ষ থেকে পুলিশে এফআইআর করা হয়, এটা দুর্ঘটনা নয়, খুন। তার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত চাই ও দোষীদের শাস্তি চাই। পুলিশ বহরমপুরে পোস্ট মর্টেম করাতে নিয়ে যায় দেহ।
তারপরই শুরু হয় আর এক অধ্যায়। ওইদিন ১১ নভেম্বর সন্ধ্যেবেলা বাসুদেবপুর ঘিরে ফেলে র্যাফ এবং জঙ্গিপুরে সাইফুদ্দিনের পরিবারের লোকজনকে মারধোর করা হয়। ১২ নভেম্বর মালদার কংগ্রেস সাংসদ ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আবু হাসেন চৌধুরি তাঁর দলবল নিয়ে আসেন মৃতের বাড়িতে। দেখা যায়, তাদের পাশেপাশে ওই বাড়িতে গিয়ে ঢুকেছে জগন্নাথ চৌধুরির ডান হাত মুজিবুর রহমান ও টুণ্ডা। লোকে তাদের ওপর চড়াও হয়। তারা চৌধুরি সাহেবের গাড়িতে গিয়ে লুকোয়। কিন্তু চৌধুরির বডিগার্ডরা তাদের গাড়ি থেকে বের করে আনে। তাদের কোমরে পাওয়া যায় আঠারো ইঞ্চির চাকু। র্যাফ তাদের গ্রেফতার করে।
এলাকার ছোটো ছোটো পার্টি ওয়েলফেয়ার পার্টি অব ইন্ডিয়া, এসডিপিআই প্রশাসনের সাথে দেখা করে এবং হত্যার তদন্ত, দোষীদের শাস্তি, এলাকায় পুলিশি অত্যাচার বন্ধ, এবং গ্রেপ্তার হয়ে আছে যারা তাদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানিয়ে আসে। কিন্তু ১৪ তারিখ একটি মৌন মিছিল করতে গেলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। তর্কাতর্কির পর একটি ছোটো এলাকায় মিছিল করার অনুমতি দেওয়া হয়, সেখানেই সহস্রাধিক মহিলা মিছিলে অংশ নেয়। আজ ১৫ নভেম্বর সামশেরগঞ্জ, সূতি ও ফারাক্কা ব্লকে এসডিপিআই বন্ধ ডেকেছিল।
Leave a Reply