কুশল বসু, কলকাতা, ১৬ ডিসেম্বর, মানচিত্র উইকিপিডিয়া থেকে নেওয়া, কলাবন ধ্বংসের ছবি এপি-র#
টাইফুন পাবলো | |
@ | মৃত হাজারের বেশি, উদ্বাস্তু কয়েক লক্ষ, গতবছরেও ঘটেছিল একই মাপের বিপর্যয়; |
@ | সোনার খনি আর বাণিজ্যিক কলা চাষের জন্যই কমপোস্টেলা উপত্যকায় মৃত্যুর মিছিল; |
ভয়ঙ্কর প্রশান্ত মহাসাগরীয় টাইফুন (সামুদ্রিক ঝড়) ‘পাবলো’ (আন্তর্জাতিকভাবে ‘বোফা’ নামে পরিচিত) এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেল ফিলিপাইন্সের দক্ষিণ পূর্বের মিন্দানাও দ্বীপপুঞ্জ, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। এখনও পর্যন্ত সরকারি হিসেবেই মৃত এক হাজারের বেশি, নিখোঁজ আরও হাজার খানেক মানুষ। ঠিক এক বছর আগে, ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে এরকমই এক বিষুব সাইক্লোন ঝড় ‘ওয়াশি’ ওই একই অঞ্চলে আছড়ে পড়েছিল, মারা গিয়েছিল অন্তত ১২৬৮ জন। রাতেরবেলা ঝড় আছড়ে পড়ায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল অনেক বেশি।
২৩ নভেম্বর মাইক্রোনেশিয়া রাজ্যগুচ্ছের অন্তর্গত পৃথিবীর অন্যতম বর্ষণমুখর দ্বীপ পোনপেই-এর দক্ষিণদিকে বিষুবরেখার প্রায় ওপর থেকে এই টাইফুনটির উদ্ভব হয় এবং পশ্চিমদিকে সরতে সরতে এর শক্তি বাড়তে শুরু করে। ১ ডিসেম্বর শক্তি বাড়িয়ে টাইফুনটি ৪নং ক্যাটেগরির টাইফুনে পরিণত হয় এবং ৩ ডিসেম্বর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এটি ভয়ঙ্কর ৫নং ক্যাটেগরির টাইফুন হয়ে ওঠে। টাইফুনটির ‘চোখ’ খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং এর বিস্তার দাঁড়ায় ২৭ কিমি। উল্লেখ্য, সামুদ্রিক ঝড়ের ‘চোখ’ হল ঝড়টির কেন্দ্রের অপেক্ষাকৃত শান্ত এবং পরিষ্কার আবহাওয়ার বৃত্তাকার, নিম্নচাপ অঞ্চল। যে ঝড় শক্তিশালী, তার ‘চোখ’ তত স্পষ্ট। আর এই চোখের বাইরেই থাকে ‘চোখের দেওয়াল’, যেখানে আবহাওয়া সবচেয়ে বেশি খারাপ থাকে। যাই হোক, ণ্ণপাবলো’ ৩ ডিসেম্বর মিন্দানাও-এর ওপর আছড়ে পড়ে এবং তিনদিন ধরে দুর্যোগ শুরু হয় ওই দ্বীপপুঞ্জে। ৯ ডিসেম্বর অবধি এই ঝড়ের প্রভাব ছিল ফিলিপাইন্সের ওপর।
মিন্দানাও দ্বীপপুঞ্জের পূর্ব উপকূলের দুই রাজ্য কমপোস্টেলা উপত্যকা এবং দাভাও ওরিয়েন্টাল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই ঝড়ে। কমপোস্টেলা উপত্যকার নিউ বাতান একটি উঠতি শহর এবং পূর্বদিকের পাহাড়গুলি একে প্রশান্ত মহাসাগরীয় টাইফুন থেকে রক্ষা করে। এই উপত্যকাটি ঐতিহ্যগতভাবে কৃষি ও মৎস্যচাষ নির্ভর। ধান, নারকেল, কফি, পেপে, কলা প্রভৃতি চাষ এবং তার রপ্তানির ওপর দাঁড়িয়ে এই অঞ্চলটি প্রাকৃতিক সম্পদের দিক থেকে ধনী। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সোনার খনি। এলোপাথারি বেসরকারি সোনার খনিতে ভরপুর এই উপত্যকা। সেখানে কাজ করার জন্য এই উপত্যকায় চলে আসে পাশের ভিসায়ান অঞ্চলের লোকেরা। এই অভিবাসীরাই এখন এই উপত্যকায় সংখ্যাগরিষ্ঠ। এছাড়াও এই উপত্যকায় বহু ছোটো ছোটো আদিবাসী গোষ্ঠীর বসবাস। পাবলো টাইফুনে সবচেয়ে বেশি মারা গিয়েছে অভিবাসীরাই। অন্যদিকে উপকূলের রাজ্য দাভাও ওরিয়েন্টাল মূলত গ্রাম প্রধান। বাঁশের ঘর বানিয়ে মানুষ বাস করে সেখানে।
গত বছরের অপ্রস্তুতির কারণে ওয়াশি ঝড়ে মৃতের সংখ্যা বেশি হওয়ায় অনেকদিন আগে থেকেই বিপদসঙ্কেত দিয়েছিল ফিলিপাইন্স প্রশাসন। সেই মতো প্রায় দুই লক্ষ মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল কমপোস্টেলা উপত্যকার নিউ বাতান এবং মনকায়ো শহরে আশ্রয়স্থলগুলোতে। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। পাশের পাহাড় এবং পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোটো ছোটো সোনার খনিগুলো ভূমিধস ঘটানোর জন্য তৈরি হয়েই ছিল। তার ওপর পাহাড়ের কোল ঘেঁষে চাষের জন্য অনেক জলাধারও বানানো হয়েছিল। উল্লেখ্য, মূলত কলা চাষ হয় সেখানে, রপ্তানির জন্য, চাষ করে অভিবাসীরাই। প্রবল ঝড়-বৃষ্টিতে জলাধারগুলো উপচে গিয়ে আর আলগা সোনার খনির মাটি সরে গিয়ে পাহাড় থেকে ভূমিধস নেমে হড়কা বান তৈরি হয়। প্রায় জলপ্রপাতের চেহারা নিয়ে সেই বান ভাসিয়ে নিয়ে যায় সমতলের আশ্রয়স্থলগুলো : স্কুল, কোর্ট, টাউন হল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রভৃতি। প্রায় আশি শতাংশ কলা চাষ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। এই সোনার খনিগুলির জন্য যে কোনো সময় ধস নামতে পারে, সেজন্য কেন্দ্রীয় ফিলিপাইন্স সরকার বারবার সতর্ক করলেও উপত্যকার প্রশাসন তা পাত্তা দেয়নি। উল্লেখ্য, ১৯৯৮ সালে ১১টি মিউনিসিপ্যালিটি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়া কমপোস্টেলা উপত্যকা রাজ্যের প্রথম নির্বাচিত রাজ্যপাল সোনার খনিগুলির মালিকদের এক আইনজীবী।
কেন্দ্রীয় ফিলিপাইন্স সরকারের পরিবেশ সচিব রামোন পাজে জানিয়েছেন, পাহাড়ের ধারের এবং নদী উপত্যকার এই অঞ্চলগুলো সামুদ্রিক ঝড়ের রাস্তায় পড়ে, এগুলি ধসপ্রবণ এবং মানুষের বসবাসের অনুপযুক্ত। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন এখানে সোনার খনির জন্য জমি লিজ দিয়েই চলেছে, আর মানুষের বসবাস বেড়েই চলেছে। পাজে ভয় দেখিয়েছেন, এবার মিলিটারি নামিয়ে জোর করে ওখান থেকে মানুষকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। ফিলিপাইন্সের রাজধানী ম্যানিলার দক্ষিণ-পূর্ব এলাকার আলবে-তে এই নীতি সফলভাবে রূপায়িত হয়েছে।
ফিলিপাইন্স রাষ্ট্র অভিবাসীদের সহায়তাকারী ইউরোপিয়ান সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অফ মাইগ্রেশন-এর কাছে আবেদন জানিয়েছে এই টাইফুনে আক্রান্ত গৃহহারাদের অস্থায়ী আস্তানা তৈরি করে দেওয়ার জন্য।
ফিলিপাইন্সের আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে, এত লোক মারা গেছে, এত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তাই ভবিষ্যতে আর কোনো সামুদ্রিক ঝড়ের নাম পাবলো রাখা হবে না।
Leave a Reply