২০০৭-০৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং আরও কিছু অর্থনৈতিক ক্ষমতাশালী দেশ গাড্ডায় পড়েছিল। আবাসন ব্যাবসা ফুলে ফেঁপে ওঠা দশা থেকে হঠাৎই ধপ করে পড়ে যায় যখন প্রচুর সাধারণ ক্রেতা, যারা ধার করে বাড়ি কিনেছিল, তারা ঋণখেলাপী হয়ে গেল। পরিভাষায় এর নাম ‘হাউসিং বাবল বাস্ট’। এর ফলশ্রুতিতে গোটা অর্থনৈতিক দুনিয়া চরম মন্দায় পড়ে, বেকারত্ব বেড়ে যায়, ধারে কেনায় অরুচি দেখা দেয় মানুষের মধ্যে, বিক্রি না হওয়ার আশঙ্কায় উৎপাদন কমিয়ে দিতে বাধ্য হয় কর্পোরেটরা, পুঁজির সঞ্চলনে ভাঁটা আসে। মূলত মার্কিন দেশে এর প্রভাব পড়লেও সমস্ত অর্থনৈতিকভাবে উন্নত এবং উন্নতিকামী দেশই এর আওতায় চলে আসে। এই মন্দার ভাব এখনো কাটেনি।
মিডিয়ার লেখাটেখা পড়ে মনে হয়েছিল, ওই মন্দার কারণ দুটি : ১) ব্যাঙ্কগুলো যাকে খুশি ঋণ দিয়ে দিয়েছে, শোধ করতে পারার আওকাত আছে কি না তা না জেনেই। ২) সেই সব ঋণ ব্যাঙ্কগুলো ‘প্যাকেজ’ করে শেয়ার বাজারে বেচে দিয়েছে এবং ‘মার্কিন মুলুকের ঋণ কি আর শোধ হবে না, নিশ্চয়ই হবে, সুদে আসলে শোধ হবে’ — এই অগাধ আস্থা নিয়ে সেসব ঋণ কিনে নিয়েছে সারা বিশ্ব্বের বিভিন্ন সংস্থা, ব্যাঙ্ক, ব্যক্তি।
ওই মন্দার কারণ হিসেবে তাই চিহ্নিত হয়েছিল ঋণদায়ী ব্যাঙ্কগুলোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার গোলযোগ। কাকে ঋণ দেবে না দেবে তার নজরদারির অভাব। কোন ঋণের ‘প্যাকেজ’ কতটা ‘নিরাপদ’ আর কতটা ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ — তা নির্ধারণে নিয়ন্ত্রণী এবং রেটিং সংস্থাগুলোর ব্যর্থতা বা কখনো কখনো দুর্নীতি।
আমাদের রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বর্তমান গভর্নর রঘুরাম রাজন ওই মন্দার প্রাকমুহূর্তে আইএমএফ-এর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পদে ছিলেন। ২০০৫ সালে একটি গবেষণাপত্রে তিনি বলেছিলেন, মার্কিন দেশের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক চড়া সুদের হারের দশা থেকে সুদের হার অত্যন্ত কমিয়ে দিয়ে ভুল করছে। এই অর্থনৈতিক উদারীকরণ বা মুদ্রানীতির সরলীকরণে মন্দার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। অর্থাৎ, মন্দার আসল কারণ নীতিগত, নিয়ন্ত্রণ নজরদারির শিথিলতা নয়। উল্লেখ্য, ২০০১ সালের ডটকম বাবল বাস্টের পর অর্থনীতির হাল ফেরাতে ঋণের ওপর সুদের হার কমিয়ে দিয়েছিল (৬.৫ শতাংশ থেকে ১ শতাংশ) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কয়েকবছর পরে অবশ্য তা বাড়ানো হয়েছিল কিছুটা।
যাই হোক, রঘুরাম রাজনের এই দূরদৃষ্টির কারণে তাকে ২০০৭-৮ এর মন্দার অন্যতম ভবিষ্যদ্বক্তা বলে ধরা হয়। কিন্তু তাঁর ২০০৫ সালের মতটি খারিজ করে দিয়েছিল অর্থনীতি মহল, ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রগুলি এবং লগ্নি সংস্থাগুলো। তাকে ‘লুড্ডাইট’ বলে ডাকা শুরু হয়। ঐতিহাসিকভাবে লুড্ডাইট হল ঊনবিংশ শতকের ইংল্যান্ডে টেক্সটাইল শিল্পের শ্রমিকরা যারা শিল্পে যন্ত্র বসানোর বিরোধিতা করেছিল। লুড্ডাইট — অর্থাৎ প্রগতি বিরোধী।
সেই রাজন সম্প্রতি লন্ডনের একটি বিজনেস শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে একটি বোমা ফাটিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যেভাবে নিজের দেশের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে প্রতিটি দেশ সুদের হার কমাচ্ছে, মুদ্রানীতির সরলীকরণ করছে একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে — তাতে ১৯৩০ সালের মতো মহামন্দা আসার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। ওই সময়েও একই জিনিস ঘটানো হয়েছিল। কিন্তু এবারে যদি মহামন্দা আসে, তবে তা আর গুটিকয় দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, তাতে জড়িয়ে যাবে সারা পৃথিবীর সমস্ত দেশ। তাই প্রয়োজন কেন্দ্রীয়ভাবে সবাই মিলে বসে চ্ছ্রখেলাটির নিয়মকানুন’ তৈরি করা।
এতে ফের চটে গেছে সারা পৃথিবীর মাতব্বররা। আমাদের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক প্রেস বিবৃতি দিয়ে রাজনের বক্তব্যটি অস্বীকার করে।
কিন্তু চটে গেলেও তারা জানে, রাজন যা বলেছেন, তা সত্যি কথা। ঝুলি থেকে বেড়ালটা বের করে দিয়েছেন রাজন।
মহামন্দার আশঙ্কা আমাদের প্রগতির পথটিকেই অন্ধকারাচ্ছন্ন করে দিয়েছে। ওই পথে হেঁটে মানুষ সুখস্বাচ্ছন্দ্য-স্বচ্ছলতা অর্জন করবে — এই আশার আলো ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে ওই পথের পথিকদের কাছেও।
Leave a Reply