শমীক সরকার, ১১ জুলাই#
ইজরায়েল-প্যালেস্তাইনের দ্বন্দ্ব অনেক দিনের পুরনো। যারা এর আধুনিক ইতিহাসটা ঠিক জানে না, তাদের জন্য সংক্ষেপে ইতিহাসটি নিচে বিবৃত হলো :
দ্বন্দ্বের আধুনিক ইতিহাস
আধুনিক ইজরায়েল-প্যালেস্তাইনের দ্বন্দ্বের একটি ইতিহাস আছে, তা হলো ঊনবিংশ শতকের আরব জাতীয়তাবাদ এবং ঈহুদিদের জিওনিজম-এর মধ্যে প্যালেস্তাইনের পবিত্র ভূমির উত্তরাধিকার সংক্রান্ত লড়াই। বিংশ শতকের শুরু থেকেই লড়াই আঞ্চলিক দাঙ্গায় (ইহুদি প্যালেস্তানি বনাম আরব প্যালেস্তানি) রূপান্তরিত হতে শুরু করে, ১৯৪৭ সালে তা প্যালেস্তাইনের বিস্তীর্ণ এলাকায় গৃহযুদ্ধের রূপ নেয়, ১৯৪৮ এ শুরু হয় প্রথম আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ, যার জের ধরে ওই বছরই পাশ্চাত্য দুনিয়ার প্রত্যক্ষ মদতে প্যালেস্তাইনের মধ্যেই ইহুদি রাষ্ট্র ইজরায়েলের পত্তন ঘটে।
এরপর এই যুদ্ধ বারবার হয়েছে। ঈহুদিরা সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রবল ধর্মপ্রাণ বণিক-জাতি, তাদের ধনের জোর, অস্ত্রের জোর এবং মার্কিন তথা শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে আঁতাত অনেক বেশি — ইজরায়েল হলো সেই দুনিয়াজোড়া ইহুদিদের নয়নের মণি। এদের তুলনায় প্যালেস্তানি আরবরা অর্থবল তথা সামরিক ক্ষমতায় নেহাতই শিশু। কিন্তু তাদের সঙ্গে রয়েছে আরব দুনিয়ার প্রকট বা প্রচ্ছন্ন সমর্থন। যাই হোক, এই লাগাতার যুদ্ধে ইজরায়েলি রাষ্ট্র ধীরে ধীরে প্রায় পুরো প্যালেস্তাইনটাই কব্জা করে নিয়েছে। ইহুদি বেনিয়ারা রাষ্ট্রের মদতে আরবদের হটিয়ে দখল করে নিয়েছে মাটি। নিচের ম্যাপ থেকে পরিষ্কার — কীভাবে ধীরে ধীরে এই কাণ্ডটা ঘটেছে। একদিকে গাজা, আর অন্যদিকে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক — এইদুটি জায়গাতেই এখন আরবরা সীমাবদ্ধ। ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক অংশটি প্যালেস্তাইনের অফিসিয়াল রাষ্ট্রের ঠিকানা — তবে এখানে ইজরায়েলি রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দাপট-ই বেশি। প্যালেস্তাইনি রাষ্ট্র স্বাভাবিকভাবেই ইজরায়েলের সঙ্গে প্রকাশ্য সংঘাতে যায় না এখানে।
আর ভূমধ্যসাগর তীরে মিশর লাগোয়া একফালি গাজা — এখানে এখন আর কোনো ইজরায়েলি বাহিনী নেই। প্যালেস্তাইনের এই অংশটিই ইজরায়েলের থেকে সত্যিকারের স্বাধীন — যদিও সমুদ্র বন্দর অবরুদ্ধ ইজরায়েলি সেনার হাতে। এখানে রাজনৈতিক ক্ষমতা হামাস নামে একটি আরব জাতীয়তাবাদী সশস্ত্র সংগঠনের হাতে, যাদের উদ্দেশ্য ইজরায়েলি আগ্রাসন খতম করা। এই গাজা-কে উদ্দেশ্য করে, হামাসের কোমর ভাঙতে চেয়ে মাঝেমধ্যেই বোমারু বিমান হানা চালায় ইজরায়েলি সেনা। আর হামাস ও অন্যান্য জেহাদী গোষ্ঠী ইজরায়েলকে লক্ষ্য করে রকেট ছোঁড়ে। সীমান্ত বরাবর গাজা থেকে আসা রকেট প্রতিহত করার জন্য ইজরায়েল বানিয়ে রেখেছে বিশাল দেওয়াল। তাই গাজার রকেটে ইজরায়েলের শহরগুলির প্রায় কোনো ক্ষতি হয় না, কিন্তু ইজরায়েলের বোমারু বিমান প্রতিবার শয়ে শয়ে গাজাবাসীকে কচুকাটা করে, শিশু-মহিলা কেউই বাদ যায় না। তবে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক এলাকায় কিছু প্যালেস্তানি জেহাদি গোষ্ঠী কাজ করে, হামাসেরও গোপন সংগঠন সেখানে আছে। আর ইজরায়েলের সমাজ রাজনীতিতে দখলদার বণিক-ইহুদিরা খুবই শক্তিশালী — তারা চায় সব জায়গা থেকে প্যালেস্তানি, অর্থাৎ আরবী (মূলত: মুসলিম)-দের হটিয়ে দিতে। ২০১২ সালে মিশরের তৎকালীন শাসকদল মুসলিম ব্রাদারহুডের মধ্যস্থতায় সেবারের মতো গাজা-ইজরায়েল যুদ্ধ শেষ হয় এবং সংঘর্ষবিরতি ঘোষিত হয়। লোকে বলে, মুসলিম ব্রাদারহুড যেহেতু হামাসের ঘনিষ্ঠ — তাই সেই সংঘর্ষবিরতিতে লাভবান হয়েছিল হামাস।
যাই হোক, ২০১২ সাল থেকে এখনও অবধি হামাস একটিও রকেট ছোঁড়েনি ইজরায়েলে — ইজরায়েলও বোমারু বিমান হানা চালায়নি গাজার ওপর (যদিও গাজার কিছু জিহাদি গোষ্ঠী এরমধ্যে কয়েকবার রকেট ছুঁড়েছে ইজরায়েলকে লক্ষ্য করে, কিন্তু বছর পাঁচেক আগের তুলনায় তা প্রায় কিছুই নয়)। তবে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক এলাকায় হামাসের দাপট ধীরে ধীরে বাড়ছিল, ইজরায়েলের সমাজ রাজনীতিতে দখলদার বণিক-ইহুদীদের দাপট বাড়ছিল। আর মিশরে ব্রাদারহুড সরকারের পতন হয়েছে সামরিক অভ্যুত্থান ও নাগরিক অসন্তোষের মধ্যে দিয়ে, এখন তারা নিষিদ্ধ সংগঠন এবং মিশরের নয়া সামরিক সরকার ব্রাদারহুড নেতাদের ধরে ধরে মৃত্যুদণ্ড দেওয়াচ্ছে।
এবারের যুদ্ধের সূত্রপাত
এই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ওপর দাঁড়িয়ে ১২ জুন ইজরায়েলে লোক জানাজানি হয় যে তিনজন ইহুদি ইয়েশিভা কিশোরকে অপহরণ করা হয়েছে, অপহরণ করেছে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের একটি শহর হেব্রন-এর হামাস ইউনিট। এই অপহরণের পর ওই কিশোরদের খোঁজে টানা ১৮ দিন ধরে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের হাজার হাজার আরব প্যালেস্তানির বাড়ি বাড়ি ঢুকে সার্চ অপারেশন চালায় ইজরায়েলি সেনা, বহু আরব প্যালেস্তানি গ্রেপ্তার হয়। অবশেষে ১ জুলাই ওই তিন কিশোরের মৃতদের পাওয়ার পর সত্যটা সামনে আসে।
অপহৃত তিন কিশোরের একজন, জিলাদ শায়ের অপহরনের পরই সেলফোন থেকে ফোন করে ণ্ণমোকেদ ১০০’ (ইজরায়েলের আপৎকালীন টেলিফোন পরিষেবার নাম্বার)-তে চাপা গলায় ফোন করে বারবার বলতে থাকে, ণ্ণআমাদের ওরা কিডন্যাপ করেছে’। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই টেপে শোনা যায় একটা আদেশের শব্দ, ণ্ণমাথা নিচু করো’। তারপর কয়েকটি গুলির শব্দ, দু-বার আর্তচিৎকার, ফের গুলির শব্দ, তারপর আরবী ভাষায় গানের শব্দ। এই টেপ মোকেদ শোনে পরদিন সকালে। ওইদিন সন্ধ্যেবেলায় খোঁজাখুজি করে পাওয়া যায় অপহরণকারীদের পরিত্যক্ত হিউনডাই গাড়ি, আটটি বুলেটের দাগ, এবং গাড়ির গায়ে ওই কিশোরদের ডিএনএ-এর ছাপ। সন্ধ্যের মধ্যেই সরকার জেনে যায়, মারা গেছে কিশোররা। কিন্তু ইজরায়েলি রাষ্ট্রের নির্দেশে এই মৃত্যু গোপন করে ফেলা হয়, এবং কানাঘুষো শোনা মিডিয়ার সঙ্গে আঁতাত করে পরিকল্পনা করে ফেলা হয় — সম্পূর্ণ চেপে যাওয়া হবে এই মৃত্যুর খবর — প্রচার করা হবে জ্যান্ত খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে তিন কিশোরকে। সেই খোঁজের অঙ্গ হিসেবে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের প্রতি ঘরে তল্লাশি চালানো হবে, গ্রেপ্তার করা হবে, সেখানে হামাসের বেড়ে ওঠা সংগঠনকে উৎপাটিত করার জন্য।
মিডিয়া-ফ্যাসিবাদ
সেই মতো ইজরায়েলি ইলেকট্রনিক মিডিয়া এক নির্লজ্জ মিথ্যা পরিবেশন করতে থাকে আঠারো দিন ধরে। অপহৃত কিশোরদের মায়েদের ২৪ ঘন্টা টিভি স্টেশনে বসিয়ে রাখা হয়। সেখান থেকে তাদের দিয়ে এমনকি রাষ্ট্রপুঞ্জের কাছে অবদি আবেদন করানো হয় তাদের ছেলেদের ণ্ণজ্যান্ত’ অবস্থায় উদ্ধার করে দেওয়ার জন্য। মিডিয়ার এই টানা প্রচারের প্রভাবে ইজরায়েলের সাধারণ বাসিন্দারা তীব্রভাবে প্রভাবিত হয়। এরপর জুন মাসের শেষদিকে যখন প্রকাশ পায়, ওই কিশোররা বেঁচে নেই, তখন শুরু হয়ে যায় ব্যাপক প্রতিবাদ, যুদ্ধ উন্মাদনা, এমনকি দাঙ্গা। একইসাথে ইজরায়েল রাষ্ট্রের পক্ষে মিডিয়া মারফৎ প্রচার করা হয়, হামাস মেরেছে এদের। এটাও একটা বানানো কথা। সবাই জানে, হেব্রণ শহরের হামাস ইউনিট-টি নামেই হামাস ইউনিট, আসলে সেটি একটি অপরাধী পরিবার, এবং হামাস নেতৃত্বকে কাঁচাকলা দেখিয়ে নিজেরাই ঘটনা ঘটিয়ে দেওয়ার বহু ইতিহাস এদের রয়েছে। ইজরায়েলের জনগণের মধ্যে থেকে দাবি উঠে আসে, গাজায় হামাসকে ধ্বংস করতে হবে। এমনকি এরকম দাবিও ওঠে যে গাজা দখল করে নিক ইজরায়েল। ইজরায়েলের মধ্যেই এই দাবির সমর্থনে হিংসা শুরু হয়ে যায়। একজন প্যালেস্তানি কিশোরকে অপহরণ করে খুন করে ইজরায়েলি জনতা।
এই রকম উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে গাজার হামাস নেতৃত্ব বুঝতে পেরে রকেট হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এবার গাজার হামাস নেতৃত্ব আত্মগোপন করে। ক্যাডারদের হাতে পরে থাকে রকেটগুলোর দায়িত্ব। গাজা-ইজরায়েল সীমান্তের সুরঙ্গপথগুলি দিয়ে আক্রমণ চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল হামাসের ক্যাডাররা, এরকমই একটা প্রস্তুতির সময় ১৯ জুন একটি বোমা ফেটে কয়েকজন হামাস ক্যাডার মারা যায়। এতে গাজায় দৃঢ় ধারণা তৈরি হয়, আসলে ওদের মেরেছে ইজরায়েলি সেনা, এবং যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। অপরদিকে ইজরায়েলের যুদ্ধবাজরা প্রচার শুরু করে, ওই যে হামাস যুদ্ধবিরতি ভাঙছে। ২৯ জুন প্রথম আকাশপথে বোমা ফেলে ইজরায়েল, গাজায় হামাসের রকেট-বাহিনীর ওপর। পরদিন গাজা থেকে ইজরায়েলের ওপর রকেট হামলা শুরু করে হামাস, ২০১২-র পরে এই প্রথম।
সেই থেকে এখনও অবধি (১১ জুলাই) ইজরায়েলের আকাশ বোমা গাজার ওপর পরেই চলেছে, আর গাজা থেকে চলছে রকেট হামলা। ইজরায়েলিদের ইতর বিশেষ কিছু না হলেও গাজায় শতাধিক লোক মারা গেছে এখনও পর্যন্ত। যুদ্ধের প্রথম দশদিনেই ইজরায়েল ১১০০-র বেশি আকাশ বোমা ফেলেছে, অপরপক্ষে গাজা রকেট ছুঁড়েছে শ’পাঁচেক — যদিও মনে রাখা দরকার, ইজরায়েলি আকাশ বোমার তুলনায় ওই রকেটগুলো প্রায় কিছুই নয়। ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক জুড়ে চলছে আরবি প্যালেস্তানিদের প্রতিবাদ মিছিল।
Leave a Reply