কুরুভিল্লা জন, দি হিন্দু-তে ১১ নভেম্বর প্রকাশিত ইংরেজি লেখার অনুবাদ চূর্ণী ভৌমিকের। লেখক ভারত রাষ্ট্রের অবসৃত আমলা#
ভলতেয়ারঃ কাগজের নোট ক্রমেই তার আদত মূল্য ফিরে পায় — শূণ্য
গত ৩০০ বছরে ব্রিটিশ পাউন্ডের দাম ৯৯% পড়ে গেছে। ১৯৯০এর দশকে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে টাকার মূল্যের ওঠা পড়াও এই লেখার ভূমিকায় ব্যবহৃত সাবধানবাণীকেই সঠিক প্রমাণ করে। ব্যায়ের অতিবৃদ্ধি, প্রচুর পরিমাণে বিদেশী ঋণ এবং ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতি আমাদের ক্রমশ এক অথৈ জলে ঠেলে ফেলে দিচ্ছে।
বড় বড় রাজনৈতিক নেতা, আমলা ও ক্ষমতাশালী ভারতীয়রা নিদারুণ ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। আর তাদের ভুলগুলির কারণে জ্বালানির দাম অযৌক্তিক ভাবে বেড়ে চলেছে, ফলে ঘটছে সামগ্রিক মূল্যবৃদ্ধি, আরও গরীব হচ্ছে মানুষ, ধ্বসে পড়ছে আমাদের জনপরিবহণের ভঙ্গুর অর্থনীতি।
মুদ্রাস্ফীতি, ফিসকাল ঘাটতি, কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ঘাটতি এবং টাকার দাম পড়ে যাওয়া কোন বিচ্ছিন্ন অসংলগ্ন বিষয় নয়। এরা চক্রাবর্তের মতো একে অন্যের কারণ ও ফল।
‘ফুয়েল কারফিউ’ এবং আরেকপ্রস্থ নির্মম মূল্যবৃদ্ধির হুমকির পদক্ষেপগুলি নির্বিচার মরিয়া চেষ্টার লক্ষণ। আসলে কল্পনাশক্তির অভাব এবং ব্যক্তিগত পরিবহনের পরিবর্তে জনপরিবহনের পক্ষে প্রচারের মাধ্যমে সামগ্রিক জ্বালানি খরচের হার কমানোর প্রতি অনীহা । ঢেঁকি মতই একটা দিক স্থির হলেই অন্য প্রান্ত অস্থির হয়ে ওঠে- জ্বালানির দাম বাড়লে বাড়ে পরিবহন খরচা ফলে সাধারণভাবে মুদ্রাস্ফীতি ঘটে এবং সরকারি খরচাও হয় বেশি- বেড়ে যায় মহার্ঘভাতা, বাড়ে যাতায়াত থেকে কেনাকাটা, ভাড়া নেওয়ার খরচ (ছাপিয়ে যায় জ্বালানির দাম বাড়ানোর ফলে হওয়া সাশ্রয়কে) – অতএব ফের ফিসকাল ঘাটতি। হাত পাততে হয় বাইরে, যেতে হয় এফআইআই, এফডিআই দের দরজায়, যার পরিষেবার মূল্য চোকাতে গিয়ে ফের কারেন্ট অ্যাকাউন্টে ঘাটতি, অতএব ফিরে এলাম সেই যে কে সেই আগের দশায়।
আমাদের কষ্ট লাঘব করার জন্য পেট্রলের কম ব্যবহার করানোর প্রচেষ্টা বানচাল হয়ে যায় বিভিন্ন দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক গোলমেলে বিষয়ের চাপে। রান্নার গ্যাসের ভরতুকির টাকার সরাসরি হাতে দেওয়ার যে ব্যবস্থা মোটের উপর সফল ভাবে চালু হয়েছে, সেই একই ব্যবস্থার সাহায্যে এই তেলের ব্যপারটাকে হাত ফসকে যাওয়া থেকে বাঁচানো যেতে পারে ঃ
ক। প্রতি মাসে/ সপ্তাহে/ পক্ষে পেট্রল/ডিজেল/গ্যাসের আসল দাম পরিষ্কার ভাবে ঠিক করা হোক, ভারত সরকারের নির্দিষ্ট স্থায়ী কোন বিচারবিভাগীয় পেট্রলিয়াম কমিশনের সাহায্যে।
খ। ৯টা গ্যাস সিলিন্ডারের মতোই ভর্তুকিভুক্ত করে বরাদ্দ করা হোক পরিবার পিছু জ্বালানির নির্দিষ্ট পরিমাণ, তা সেই পরিবারের যতগুলো মোটরগাড়ি থাকুক [ধরা যাক ৬০০ লিটার পেট্রোল বা ডিজেল প্রতি বছর]
গ। রান্নার গ্যাসের মতই মোটরগাড়ির মালিক পেট্রল পাম্পে পুরো দাম মেটাবে, আর সঙ্গে সঙ্গে তার আধার কার্ডে থাকা ব্যাঙ্ক একাউন্টে ভর্তুকির টাকা পাঠিয়ে দেওয়া হোক।
ঘ| এই বরাদ্দ পরিমাণের থেকে বেশি তেল কেউ কিনতেই পারে, কিন্তু তার জন্য ভর্তুকি পাবে না, যেমন গ্যাসের ক্ষেত্রে নিয়ম করা হয়েছে।
[পরে এই ভর্তুকিতে আরো সূক্ষ বিভাজন আনা যেতে পারে, যেমন তেল-সাশ্রয়কারী ছোটো গাড়ির জন্য একরকম ভর্তুকি আর তেল-খেকো লিমুজিনের জন্য আরেকরকম।]
গ্রীক রূপকথায় অ্যাটলাস যেমন একা এই পৃথিবীটাকে কাঁধে ধরে রাখার চেষ্টা করেন তেমনি আমাদের অর্থমন্ত্রী, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর এবং অধুনা পেট্রলিয়াম মন্ত্রী টাকার মূল্যের অধঃপতন রক্ষার চেষ্টা করছেন। এই লেখক মনে করে, এই হলো উপযুক্ত সময় সঠিক পন্থা নেওয়ার।
গাড়িবারান্দায় রাখা আমাদের পুরনো ধুলো পড়া সাইকেলটা যাতে রাস্তায় চালানো যায় তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সেটাকে ঝেড়েঝুড়ে ন্যাতানো টায়ারে হাওয়া ভরে তেল মাখানো হল। দারুণ! দিব্যি চলে – জ্বালানি ছাড়াই। এক আশ্চর্য অভিযানের আশায় দৃপ্ত ভঙ্গিতে ধীরেধীরে প্রাগৈতিহাসিক সাইকেল বেরিয়ে এলো আমাদের কলোনির গলি থেকে ব্যস্ত রাস্তায়। কৌতুক ভরে মোটরবাইকওলারা এই টলোমলো ‘বিলুপ্ত প্রজাতি’র যানটির পাশ কাটিয়ে গেল একটু দূরত্ব বজায় রেখে, আর ঝকঝকে লিমুজিন গাড়িগুলো সাঁইসাঁই করে বেরিয়ে গেল তাদের এই হতদরিদ্র রাজস্বের বালাইহীন কুটুমটির দিকে দৃকপাত না করে।
মৃতপ্রায় টাকার অবস্থা ফেরানোর শ্রেষ্ঠ দাওয়াই – প্রতিবার জ্বালানির দাম বাড়ার সাথে সাথে আসুন আমরা চালু করি স্বপ্নের সাইকেল লেনগুলো, হারিয়ে যেতে বসা ফুটপাথ, লুপ্তপ্রায় প্রজাতির ক্রসিং, আর ঘষেমেজে ফেলি আমাদের সড়ক পরিবহণ নিগমগুলোকে।
এই লেখকের ৬২ বছরের ফুসফুস দুটো সাইকেলের প্যাডেলের তালে তালে ফুঁসছিল আর ভাবছিল, কেন চিরটাকাল সহজ সমাধানগুলো আমাদের নজর এড়িয়ে যায়। বাতাসের কানে কানে স্বগতোক্তি — ‘সত্যমেব জয়তে’ ‘সাদা জীবন, উচ্চ বিচার’, স্বদেশী — কে থাকবে ভারতবর্ষে যদি ভারতীয় মুদ্রা মারা যায়?
Leave a Reply