পোয়াতুরকুঠিবাসী প্রবীন মনসুর আলি মিঞা-র বয়ান, বোঝার সুবিধার জন্য ভাষার পরিবর্তন করেছেন সোমনাথ চৌধুরি, কোচবিহার, ৩০ আগস্ট#
১৯৭১ সালে পাকিস্তান অভ্যুত্থান হয়ে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। তারপর ১৯৭৪ সালের ১৬ মে দিল্লীতে ইন্দিরা গান্ধী ও শেখ মুজিবর রহমানের মধ্যে ছিটমহল চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট শেখ মুজিবর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। কিন্তু ছিটমহল ও অন্যান্য সমস্যার সমাধান সেখানেই আবার বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ১৯৯২ সালে নরসিমা রাও ও খালেদা জিয়ার মধ্যে ছিটমহল সমস্যা সমাধানের জন্যে পুনরায় চুক্তি হলেও তা বাস্তবায়িত হয় না। তারপর দহগ্রাম ও আঙারাপোতা বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনবিঘা সমস্যা সমাধান হয়। কিন্তু আমাদের অবস্থা যা ছিল তাই রয়ে গেল।
অমর রায় প্রধান যখন এম.পি ছিলেন তিনি ছিটমহল সমস্যা নিয়ে লোকসভায় আলোচনা তোলেন। সরকারপক্ষ থেকে বলা হয় ‘ছিটমহল জঙ্গল, লোক থাকে না’ — এই নিয়ে পরবর্তীকালে তিনি বই রচনা করেন — ‘রুল অব জঙ্গল’। ১৯৯৪ সালে অমর রায় প্রধান, হিতেন নাগ, দীপক সেনগুপ্ত ও সৌমেন দাসের নেতৃত্বে ‘ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি’ গঠিত হয়। এই কমিটির সম্পাদক মনোনীত হন শ্রী দীপক সেনগুপ্ত। ২০০২ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিমান বসুর টেবিলে ও বাংলাদেশের হাই কমিশনারের কাছে আমাদের দুঃখ দুর্দশার কথা তুলে ধরা হয়। ২০০৯ সালে উভয় দেশের মধ্যে ছিটমহল নিয়ে আলোচনা সম্প্রসারিত হয়, কিন্তু হঠাৎ রোগাক্রান্ত হয়ে আমাদের প্রিয় নেতা দীপক সেনগুপ্তের মৃত্যু হয়। দীপক সেনগুপ্তের মৃত্যুর পর তাঁর সুযোগ্য পুত্র শ্রী দীপ্তিমান সেনগুপ্তকে সহসম্পাদক হিসেবে মনোনীত করা হয়।
২০১০ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট হুসেন মোহাম্মদ এরশাদ সাহেব তাঁর জন্মভূমি দিনহাটায় আসেন এবং ছিটমহলবাসীর ৬৫ বছরের দুঃখ দুর্দশার কথা শোনেন। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন ‘এই ব্যাপারে আমাদের সরকারকে অবগত করাব’ সেই দিন থেকেই সমন্বয় কমিটির আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পরে।
২০১১ সালের ৫ জানুয়ারি উভয় দেশের সচিবদের মধ্যে বৈঠক শুরু হয় এবং ২ দেশের যৌথ কমিটি গঠন হয়। ওই বছরই ১৮ জুলাই ও ১৯ জুলাই দুই দেশের মধ্যে জনগণনা ও বাড়ি বাড়ি হোল্ডিং নম্বর দিয়ে পরিসংখ্যান করানো হয়। তারপর ৬ ও ৭ ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে কথাবার্তার পর ১৯৭৪ সালের চুক্তি অনুযায়ী প্রোটোকল স্বাক্ষরিত হয় কিন্তু সমাধান আর হয় না।
এতদিন আমাদের ছিটমহলবাসীর জীবনে ছিল ৩টে জেল, প্রথমটা জন্মগত জেল আর দুইটা রাষ্ট্রীয় জেল। জেলবন্দীদের নিরাপত্তা রয়েছে এবং বনজঙ্গলের জীবজন্তুদের দেখার জন্যে সরকার রয়েছেন। আমাদের দেখাশোনা করা জন্যে উপরে ঈশ্বর বা আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ ছিলেন না।
বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী দিপুমণি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তিস্তা জলবন্টন ও ছিটমহল বিষয় সমাধানের জন্যে বলেছিলেন। এই ব্যাপারে দিল্লী থেকে বিদেশমন্ত্রী রঞ্জন মাথাই কোলকাতায় এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তিস্তা জলবন্টন ও ছিটমহল বিনিময় নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেন। এই ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মতামত চাওয়া হলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, ‘আমাদের জমি বেশি যাবে তাই হস্তান্তর করব না’। সেই বক্তব্যের পর ছিটমহলবাসীর পক্ষ থেকে অনশনের হুমকি দেওয়া হয়। ২০১২ সালের ১২ মার্চ ‘ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি’র পক্ষ থেকে উভয় দেশেই আমরণ অনশন শুরু হয়। ছিটমহলবাসী ৮ দিন ও নেতা দীপ্তিমান সেনগুপ্ত ২৮ দিন অনশনে ছিলেন।
২০১২ সালের ১২ জুন দিল্লী থেকে ৮ সদস্যের প্রতিনিধিদল রাজ্যের কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ছিটমহল বনিময়ের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছিলেন যে বাংলাদেশ থেকে আগত ছিটবাসীর জন্যে তাঁর ভয় আছে যে তাঁদের থাকার মতো জমি তিনি দিতে পারবেন কি না। যদি কেন্দ্র এই ব্যাপারে দায়িত্ব গ্রহণ করে তবে তিনি রাজি আছেন। আইনগত পরিবর্তন হয়ে গেলে তবে দুই দেশ মিলে আলোচনার ভিত্তিতে ছিটমহল বিনিময় কার্য্যকরী করা সম্ভব।
২০১২ সালের ২ জুলাই কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিটমহল নিয়ে একটি সেমিনার হয়েছিল। সেই সেমিনারে সারা বিশ্বের ২৫-৩০ জন সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। সেই সেমিনারে আমাদের নেতার সাথে আমিও ছিলাম। এরপর ২০১৩ সালের ২ জুলাই কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সারা পৃথিবী থেকে গবেষক এসেছিলেন — আমেরিকা, জার্মানী, তাসখন্দ, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের গবেষকও ছিলেন। সেখানে আমাদের তরফ থেকে উপস্থিত ছিলেন আমাদের নেতা দীপ্তিমান ও রক্তিম। গবেষকরা দীপ্তিমান ও রক্তিমের মুখে শুনেছিলেন ছিটমহলের ৬৭ বছরের ইতিহাস। গবেষকরা সব শুনে ভারত ও বাংলাদেশ সরকারকে ধিক্কার জানিয়েছিলেন।
(চলবে)
Leave a Reply