ঝক্কি মাসির সঙ্গে অহল্যা যখন স্টেশনে এল, স্টেশনে তখন থিকথিকে ভিড়। স্টেশনের বাইরে গাঢ় অন্ধকার। লাইট পোস্টের বাতিগুলো শুধু শীতের ভোরে জবুথবু হয়ে ক্লান্ত আলো ছড়াচ্ছে। … দূর থেকে আসা আবছা একটা আলোর ফুলকি দেখতে পেয়ে যাত্রীরা সব চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। চাদর সোয়েটার কাপড় সেঁটে নিয়ে যেন যুদ্ধে নামার জন্য তৈরি হচ্ছে সব। নামখানা-লক্ষ্মীকান্তপুরের ট্রেনে উঠতে গেলে যাত্রীদের যুদ্ধ করতে হয় বইকি!
পাঁচের দুই খোপ কোথায় পড়ে ঝক্কি মাসির তা জানা। অহল্যাকে মাসি শক্ত করে ধরে। ট্রেনটা ঝমঝম শব্দ করে স্টেশনে ঢোকে। আগে ওথার জন্য হুড়োহুড়ি গুঁতোগুঁতি লেগে যায়। ঝক্কি মাসি অহল্যাকে নিয়ে সবার পিছনে। ঝক্কির হুড়োহুড়ি করার দরকার নেই। এই খোপে তার নিত্যদিনের পরিচিত যাত্রীরা জায়গা দখল করে বসে আছে। সে খোপটি শুধু তাদের জন্য বরাদ্দ। সেখানে নতুন মুখের প্রবেশ নিষেধ। যদি কোনও নতুন যাত্রী জোর করে ওদের মধ্যে ঢুকে পড়ে তো তার দিন মাটি হয়ে যায়। এপার ওপারের নিত্যযাত্রীরা এমন অসভ্যতা শুরু করে যে তাকে গন্তব্যের আগেই খোপ ছেড়ে পালাতে হয়।
ঝক্কির সাথে অহল্যাকে দেখে কামরায় যেন একটা হুলুস্থুলু পড়ে গেল। ভাগাড়ে যেন লুঠের মাল এসে পড়েছে। দাঁড়িয়ে থাকা বখাটেগুলোর পর্দাহীন সব কথাবার্তায় কলরব বাড়ছে। জোড়ায় জোড়ায় নারী-পুরুষ চাদর ঢাকা দিয়ে এক অঙ্গে লীন হয়ে, শীতের সঙ্গে লড়াই করতে শরীরের উষ্ণতা উপভোগ করছে। গোলযোগে চাদরের পর্দা ফাঁক হয়ে ঘোরলাগা ঘুম জড়ানো চোখগুলো ছুটে আসে অহল্যাদের দিকে। কি ব্যাপার?
— আমার মাতা খাস মাসি, তুই আমার খোপে আয়। অন্যজন বলে।
— সে মাসির বিচের সাত বছর ধরে মাসির জন্যি মারপিঠ করে জায়গা নে আসতিচি। মাসি কি আমার কতাভাববেনে। আর একজনের বাজখাঁই গলা ঝলসে ওঠে,
— আরে নম্পটরা চুপ কর তো সব। এটা কি মগের মুলুক নাকি। জুলুমবাজি হচ্ছে? শালা যত সব নষ্টের দল। মা বোনিদের সম্মান দে কতা বলতি শিকলিনি। তারপর গলার সুরটা খুব নরম করে বলল,
— এ খোপে কে না জানে কেষ্টদার পরে আমার নাইন। বিদ্যে বৌদি কেষ্টদার বগলে ঢুকেছে। এ আমার বগলের মাল তোরা কোত্থেকে পাবি রে হারামজাদারা।
ঢ্যাঙা কালো রগঅটা বেঢপ ছেলেটা ঝক্কি মাসিকে সাক্ষী মেনে, অহল্যার দিকে জুলজুল চোখে তাকিয়ে বিদঘুটে হাসি হেসে ওঠে। অহল্যাকে জায়গা দেওয়ার জন্য প্রায় সবাই যেন মরিয়া। এ বলে মাসি এপারে আয়। ও বলে মাসি আমার কাচে দাঁড়া।
অদ্ভুত জীবন এইসব ভোরের ট্রেনের নির্মাণ কর্মী আর ঝিয়ের কাজ করতে যাওয়া পুরুষ মহিলাদের এরা বাড়ির স্বামী-স্ত্রীর সঙ্গ পায় খুবই কম। দিনে রাতের বেশির ভাগ সময় তাদের কাটে বাড়ির বাইরে। ভোর চারটেয় গাড়ি ধরতে রাত তিনটের সময় উঠতে হয় রাতে ফিরে রান্না বান্না করে শুতে শুতে এগারোটা। শুলে আর হুঁশ থাকে না। নিত্য যাতায়াতে বেওয়ারিশ হয়ে থাকলে যন্ত্রণার অন্ত থাকে না। রাস্তার পাশে দাঁড়ানো দাবিদারহীন কুলগাছের মতো যার ইচ্ছে হয় ঢিল ছুঁড়ে আহত করে যায়। ফলে মহিলারা খোপে এলে কারো না কারো দখলে চলে যায়। স্বামী-স্ত্রীর মত এক চাদরের তলায় লেপ্টে ঘুমাতে ঘুমাতে শহরে চলে যায়। আবার ঠাট্টা মস্করা করতে করতে সময় পাশ করে ঘরে ফেরে। যাতা নিত্যযাত্রী এসব ব্যাপার তাদের গা সওয়া। সমাজের থিতু মানুষদের চোখে এসব নষ্টামী, অসহনীয়। তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। তারা তাদের ছন্দে যায় আসে। ভদ্রতা দেখালে বাক্যবানে উলঙ্গ করে ছাড়ে। দলে সাধারণ যাত্রীরা কেউ ওদের সাথে মুখ পাততে চায় না।
নোত্তো নেঙো দিয়ে গোঁত্তা মারে তার গায়ের সঙ্গে লেপটে থাকা যমুনাকে।
— এ্যাই যবু ওটনা। মেয়েটারে এট্টু বসতে দে না।
যমুনা আড় চোখে অহল্যাকে দেখে নিয়ে পাল্টা গোঁত্তা মারে নোত্তোকে।
— শালা আঁড়খোড়, ডবগা মেয়েমানুষ দেকলি জিবি জল আসে না-রে?
ভূতোর বগলের ভিতর থেকে মুখ বাড়িয়ে জবা বলে,
— আত জেগে নোত্তোর খোল শুইকে উটেচে রে যমুনে। তোর গোঙ্গা জল নে ওর মুকি এট্টু দেনা।
জবার ক্ষ্যাপাটে হাসিতে অনেকেই যোগ দিতে হাসির হুল্লোড় ওঠে সারা কম্পার্টমেন্টে।
ওপরে ‘অহল্যা’ গল্পের একটি অংশ দেওয়া হলো। এই গল্পটি ‘বাঘের রাজত্বে : সুন্দরবন বিষয়ক গল্পগ্রন্থ’ নামে একটি গল্প সংকলনের অন্তর্গত। ২৬টি গল্পের সংকলন। লেখক প্রদীপ কুমার বর্মন। প্রকাশক নাজিবুল ইসলাম মন্ডল, সমকালের জিয়নকাঠি প্রকাশনা, জীবন মন্ডল হাট, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা। লেখকের মোবাইল : ৯৭৩২৮৯৫৬৪১। প্রকাশকের ফোন : ৭৬৯৯৪৫৬৮৩২ ও ইমেল : nazibulislammondal@rediffmail.com. প্রকাশকাল ডিসেম্বর ২০১২। বিনিময় মূল্য ১৩০ টাকা।
Leave a Reply